মাকে হারিয়ে খাবার দাবার ছেড়ে দিয়েছিল বাচ্চা হাতিটি। অবশেষে মাহুতের যত্নে সুস্থ হয়ে উঠেছে সে। তার নাম রাখা হয়েছে যমুনা। কক্সবাজারের ডুলাহাজারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে গেলেই দেখা মিলবে তার। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বেশ নাদুসনুদুস হয়েছে যমুনা। লাফালাফি আর খেলাধুলা করে পর্যটক দশনার্থীদের আনন্দে মাতিয়ে রেখেছে। সবাই এখন যমুনাকে নিয়ে মহাখুশি। ইতিমধ্যে পার্কটির দর্শনার্থীদের কাছেও যমুনা হয়ে উঠেছে অন্যতম আকর্ষণ।
কক্সবাজার বন বিভাগের বনকর্মীরা জানান, মাত্র তিন মাস বয়সেই হাতির বাচ্চাটি তার মাকে হারিয়ে এতিম হয়ে যায়। গেল বছরের ৮ মার্চ টেকনাফের উঁচু পাহাড় থেকে পড়ে মারা যায় মা হাতিটি। মাকে হারিয়ে শোকে মূহ্যমান হাতির বাচ্চাটি অনবরত মা’র মরদেহের পাশে থেকে কাঁদতে থাকে। মা হারানোর কারণে তার খাবার-দাবারও বন্ধ হয়ে যায়। বনকর্মীরা অনেক চেষ্টা করেও খাওয়াতে পারেনি।
বনকর্মীরা মরদেহ মাটিতে পুঁতে ফেলার পর বাচ্ছাটি আরও কাহিল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় বনের অন্য কোনো হাতি বাচ্চাটিকে সঙ্গে নেয় কিনা বনকর্মীরা তাও দেখেছেন। কিন্তু অন্য হাতিগুলোও বাচ্চাটিকে নেয় না। সেই পাহাড়ে মায়ের মৃত্যুস্থলে ক্রমশ বাচ্চাটি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাই এক পর্যায়ে বনকর্মীরা বাচ্চা হাতিটিকে ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে নিয়ে যায়।
পার্কে নিয়ে যাওয়ার পর পরিচর্যায় যমুনা নামের হাতির বাচ্চাটি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে। এখানে যমুনার পরিচর্যায় নিয়োজিত হন মাহুত বীরুসেন চাকমা। পার্কের পশু হাসপাতাল এলাকায় ঘেরাও দিয়ে যমুনার জন্য আলাদা বেষ্টনি তৈরি করা হয়েছে। রাতদিন পরিচর্যা নিশ্চিত করতে বেস্টনির পাশেই মাহুত বীরুসেন চাকমার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে বাসা। মাহুত বীরুসেনের একমাত্র কাজ হচ্ছে যমুনাকে লালন পালন করা। এতিম অসুস্থ হাতির বাচ্চা যমুনাকে মায়ের মমতা দিয়ে লালন পালন করেন মাহুত বীরুসেন।
চকরিয়ার ফাসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী জানান, পার্কের বেষ্টনিতে থাকা হাতির বাচ্চা যমুনা এখন দর্শনার্থীদের জন্য অন্যতম আকর্ষণ। দর্শনার্থীরা দীর্ঘক্ষণ ধরেই যমুনাকে নিয়ে মেতে থাকে। যমুনার নাম ধরে ডাক দিলেই সে ছুটে আসে। দর্শনার্থীদের নানা কসরতের মাধ্যমে যমুনা আনন্দ দিয়ে থাকে।
সরেজমিনে পার্কে গিয়ে দেখা গেছে, বেষ্টনিতে যমুনা অপনমনে খেলছে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে যমুনা কাকে যেন ডাকছে এরকম করেই কেবল ডাক দিচ্ছে। যমুনার চিৎকার শুনে পাশের বাসা থেকে ছুটে আসেন মাহুত বীরুসেন। বীরুসেন জানালেন, সকাল ১১ টায় তার দুধ খাওয়ার সময়। তাই সে ডাকাডাকি করছে খাবারের জন্য। প্রতিদিন ৪ বেলা তাকে দুধ খাওয়ানো হয়। খাবারের সময় হলেই সে ডাকাডাকি শুরু করে দেয়। প্রথমাবস্থায় তাকে ফিডার দিয়ে ল্যাকটোজেন-১ দুধ খাওয়ানো শুরু করা হয়। বর্তমানে ল্যাকটোজেন-২ দুধ খাওয়ানো হচ্ছে।
যমুনার কাছে বীরুসেনই যেন তার মা। যেই বীরুসেন বেস্টনির বাইরে থেকে যমুনা বলে ডাক দেয়-তখন ভিতরে থাকা হাতির বাচ্চাটি খুশিতে লাফ দিয়ে উঠে তার কাছে আসার জন্য। যমুনা তার শুঁড় দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে। বীরুসেনও তাকে মায়ামমতায় ভরে তুলেন। বীরুসেন বলেন, ‘মায়া মমতা কেবল মানুষে মানুষে সীমাবদ্ধ নয়। আমার কাছে যমুনা যেমনি মেয়ের মতো তেমনি আবার তার কাছেও আমি মায়ের মতো। ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারি না। সেও আমার জন্য পাগল।’
পার্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফরেস্টার মাজহারুল ইসলাম জানান, ‘এখন যমুনার বয়স ১৮ মাস। তাকে যখন পার্কে আনা হয় তখন তার ওজন ছিল ২১১ কেজি আর বর্তমানে ওজন হচ্ছে ৫৫০ কেজি।’
তিনি বলেন, যমুনা বয়স অনুপাতে বেশি ওজনের হয়ে যাওয়ায় তাকে এখন খাবারের পরিমাণও হিসাব করে দিতে হচ্ছে। দুধের সাথে যমুনাকে ধীরে ধীরে কলা এবং কলা গাছ খাওয়ানোর অভ্যাসও শুরু করা হয়েছে। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই এক বছরের জন্য যমুনাকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠানো হবে। তিনজন প্রশিক্ষক তাকে টানা এক বছর পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দিবেন।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা