বগুড়ার ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ভদ্রা ও ভাদাই নদী। অন্যদিকে কারখানার বিষাক্ত পানি ও বর্জ্যরের ভারে আক্রান্ত হয়ে যৌবন নেই ভদ্রাবতী নদীর। প্রতিনিয়ত বয়ে যাচ্ছে কালো পানি। এছাড়া নদীর যৌবন ও বৈচিত্রময় রূপ ধ্বংস করে বালু উত্তোলন করায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে এসব নদী।
এক সময় নদীগুলোতে পাওয়া যেত দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছ। নদীর বুকে চলতো পাল তোলা নৌকা। শুষ্ক মৌসুমে ফসলি জমিতে পানি সেচের এক মাত্র আশ্রয়স্থল ছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে পলি জমে এবং নদী খননের কোন কার্যক্রম না থাকায় খরস্রোতা ভদ্রাবতী নদী আজ পানি শুন্য মরা খাল। প্রতিনিয়ত এই নদী দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে কারখানার ময়লা আর কেমিক্যালযুক্ত কালো পানি। যেটি মাছসহ ক্ষতি করছে ফসলি জমির।
ভদ্রাবতী নদীটি বগুড়ার করতোয়া নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে ভাদাই নদীতে পড়েছে। জেলার শাজাহানপুর উপজেলার শবরুল দিঘী থেকে ভদ্রাবতী নদীর উৎপত্তি। এই নদীর সাথে ভদ্রা ও ভাদাই নদীর সংযোগ রয়েছে। বর্তমানে এই তিন নদী ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। খননের উদ্যোগ না থাকায় সরু নালায় পরিণত হয়েছে। ভদ্রাবতী নদীটি ছিল এক সময়ের সবচেয়ে খরস্রোতা নদী। এ নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বেশ কিছু বন্দর ও ব্যবসা কেন্দ্র। দেশ স্বাধীনের পর নদীটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য করতোয়ার সাথে ভদ্রাবতী নদীর সংযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও শুষ্ক-মৌসুমে এ নদীর পানি ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। এছাড়া এই নদী থেকে মাঝেমধ্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে প্রভাবশালী চক্র। অনেকে ইচ্ছেমত নদীর দুই পাড় দখল করে ফসল ফলাচ্ছেন। যার ফলে নদী হারাতে বসেছে তার নদীত্বর রূপ। একসময় পানিতে থৈথৈ করতো ভদ্রাবতী নদী। এখন পানি না থাকায় শুকিয়ে মরছে। ১৬ কিলোমিটার এই নদী এখন মহাবিপন্ন।
শাজাহানপুর উপজেলার সাবরুল এলাকার বাসিন্দা প্রবীণ ব্যক্তি আমজাদ হোসেন জানান, দাদার মুখে শুনেছি রাজার শাসন আমলে শাবরুল দিঘীর বুক চিড়ে ভদ্রাবতী নদীর আভির্ভাব ঘটে। নদীর উৎপত্তি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া গেছে। তবে নদীর নামকরণের নেপথ্যের কাহীনি সম্পর্কে জানা গেছে। ভদ্রাবতী নদীর উৎপত্তি নিয়ে কল্প কাহীনিও বেরিয়ে এসেছে।
তিনি আরো জানান, সেন বংসের অচ্যিন কুমার নামের শেষ রাজার আমলে তার কন্যা ভদ্রাবতীর নাম অনুসারে নদীটির নামকরণ করা হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে ভরা পানিতে নদী থৈথৈ করতো। ছোট-বড় মাছ দেখা মিলতো। আগের দিনে কৃষিজমিতে সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানি নদী থেকেই ব্যবহার হতো। ভদ্রা ও ভদ্রাবতী নদী দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষেরা নৌকায় চলাচল করতো। সেইসব চিত্র আজ শুধুই স্মৃতি। নদীর যৌবন ও বৈচিত্রময় রুপ রক্ষার্থে বালু উত্তোলন, নদীতে বয়ে যাওয়া কারখানার বর্জ্য এবং কালো পানি প্রবাহিত বন্ধ করতে হবে।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ভদ্রাবতী ও তৎসংলগ্ন ভাদাই ও ভদ্রানদী পুনঃখননের জন্য প্রায় ২২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। অনুমোদন হয়ে আসলে কাজ শুরু করা হবে। সূত্রে আরো জানা যায়, তিনটি নদীর মোট ৪১ কিলোমিটার খনন কাজ করা হবে। এরমধ্যে ভদ্রাবতী ১১ কিলোমিটার, ভাদাই ১৫ কিলোমিটার ও ভদ্রা নদী ১৫ কিলোমিটার। খনন কাজে ভদ্রাবতী নদীর বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা এবং ভদ্রা ও ভাদাই নদীর জন্য ১৬ কোটি ১০ লাখ টাকা।
বগুড়া পানি উন্নয়নের বোর্ডের পওর উপ-বিভাগ-১ এর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মাদ আছাদুল হক জানান, এই তিনটি নদী পুনঃখননের জন্য প্রায় ২২কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যেটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। প্রকল্পটি অনুমোদন হলে নদীগুলো তার যৌবন ফিরে পাবে।
শাজাহানপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি এনামুল হক শাহীন জানান, সরকারি পৃষ্টপোষকতায় ভদ্রাবতীসহ তিনটি নদী খননের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। পানি প্রবাহের পথ উন্মুক্ত করে নদীর সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনা হলে নদীগুলো পাবে তার হারানো ঐতিহ্য। এসব নদী থেকে উপকৃত হবে হাজারো মানুষ। তাই নদী মাত্রিক বাংলাদেশের সৌন্দর্য্য আবহমান কালের ঐতিহ্য রক্ষায় এই পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ নাজমুল হক জানান, বগুড়ার বেশ কিছু নদী নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এরমধ্যে করতোয়া খনন ও সৌন্দর্য্যবন্ধনের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া ভদ্রাবতী, ভাদাই ও ভদ্রা নদী পুনঃখননের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল