লিওনের ঘুম ভাঙে আইরিশ, নোরার চিৎকারে।
আইরিশ ফেস্টুনে লিখছে শহীদ স্মৃতি অমর হোক। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। ক খ গ ঘ! মায়ের ভাষা মুখের ভাষা। নোরাও লিখতে চায়। সে এখনো ছোট, লিখতে পারে না। তবু সে বলছে, লিখবে।
এই নিয়ে হৈচৈ। পাশে ঘুমিয়ে লিওন। ওদের হট্টগোলে লিওনের ঘুম ভাঙে। সে প্রথমে কিছুই বোঝে না। তখন রঙতুলিতে পোস্টারে লিখছে আইরিশ। নোরা তুলি টানাটানি করে বলে, দিদিভাই আমিও লিখব।
-তুই এখনো লিখতে শিখিসনি, পারবি? দিদিভাই আইরিশ বলে।
-হ্যাঁ খুব পারব। আমি খাতায় লিখি না! দাদু আমাকে ভেরি গুড বলেছে। নোরা উত্তর দেয়।
-আরে খাতার সেই লেখা নয়। এখানে অনেককিছু লিখতে হয়। সেই তুই পারবি না। এখনো অ আ লিখতে পারিস না, পোস্টারে লিখবি, বলে হাসে।
দুজনের হৈচৈ লিওনের পাকা ঘুম ভেঙে যায়। ঘুমচোখে দেখে বড় দিদিভাই, ছোট দিদিভাই কী করছে।
সে বালিশ থেকে মাথা তুলে বসে।
দূর থেকে অতসব কি দেখা যায়? ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে বড়দিদি ভাইয়ের পেছনে দাঁড়ায়। দেখে রং দিয়ে কিসব লিখেছে। লিওনের কৌতূহল বাড়ে। নিজে ভাবে, সেও লিখবে। তাকে থামায় কে? দিদিভাইয়ের তুলি কেড়ে নেয়। আইরেশ রাগ করে না। লিওনকে কোলে নেয়। আদরের সুরে বলে, আমার মিষ্টি ভাই, তুইও লিখবি।
আগে বড়ো হ। পড়বি, লিখতে শিখবি, তারপর তুই সুন্দর করে লিখতে পারবি।
-দিদিভাই কী লিখছ?
-কাল একুশে ফেব্রুয়ারি। শহীদ দিবস।
-একুশে ফেব্রুয়ারি, শহীদ দিবস কী? লিওন প্রশ্ন করে।
-ওম্মা, তুই তো ছোট, জানিস না। বলছি, শোন। আমরা বাঙালি। বাংলাদেশ আমাদের দেশের নাম। বাংলা আমাদের মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা।
-দিদিভাই, মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা কী? নোরা প্রশ্ন করে।
- সে কী! তুইও জানিস না? আমরা জন্মাবার পরে মায়ের মুখে প্রথমে যে কথা শুনি, সেটা হলো মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষা। ওই ভাষায় আমাদের কথা বলতে দিত না।
-কারা দিত না দিদিভাই?
-পাকিস্তানিরা।
-পাকিস্তানিরা কে? নোরা আবারও প্রশ্ন করে।
-আগে আমাদের দেশ ছিল পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান। ওরা আমাদের কিচ্ছু দিত না। আমাদের দেশ থেকে সব নিয়ে যেত, ঐ পশ্চিম পাকিস্তানে। তাই দেশ স্বাধীনের জন্য সংগ্রাম করেছি। নেতৃত্ব দিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর দেশ স্বাধীন হলো।
আমরা বাংলাদেশ নামে দেশ পেলাম। বাংলা ভাষা পেলাম। বাংলা ভাষার জন্য সংগ্রাম করে যারা প্রাণ দিয়েছে রফিক, জব্বার, সালাম তাদের জন্য শহীদ মিনারে প্রতি বছর ফুল দিই। ওদের স্মরণ করতে পোস্টার লিখি।
-ও তাই।
-দিদিভাই তোমরা কখন যাবে শহীদ মিনারে। লিওন প্রশ্ন করে।
-কাল ভোরে। শহীদ মিনারে ফুল দেব। হাতে পোস্টার থাকবে। খালি পায়ে গান গাইব, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি!
-দিদিভাই আমিও ফুল দেব শহীদ মিনারে। আমি তোমাদের সঙ্গে যাব।
-নারে ভাই, তুই এখন তো ছোট, হাঁটতে পারবি না। বড়ো হ আগে। তারপর তোকেও সঙ্গে নিয়ে যাব।
-না না আমিও যাব। বলতে বলতে কাঁদতে শুরু করে।
কান্নার শব্দ পেয়ে ওদের মা ছুটে আসে। লিওনের মা বলে, লিওন কাঁদছে কেন?
-দেখ না বড়ো মা, ও নাকি আমাদের সঙ্গে ভোরে শহীদ মিনারে যাবে।
-তুই ছোট, এখন হাঁটতে পারবি না লিওন। লিওনের মা বলে।
-সেই কথাটি বারবার বলছিলাম। সে বুঝতে চায় না বড়মা।
-তোরা লিওনের ঘুম ভাঙলি কেন আইরিশ। আইরিশ ও নোরার মা
বলে।
-ছোটমা, আমি বড় দিদিভাই, ছোট দিদিভাইয়ের সঙ্গে যাব।
-ঠিক আছে, যাবি। তা’হলে একটি কাজ কর। এখন শুয়ে পড়। সকাল হলে ডেকে দেব। একসঙ্গে সবাই যাবি।
কিছু একটা বলতে চেয়েছিল আইরিশ। চোখের ইশারায় বারণ করে বড়মা। আইরিশ বুঝতে পেরে চুপ থাকে।
লিওনের মা লিওনকে নিয়ে নিজের ঘরে যায়। তখনই লিওন বলে, বড় দিদিভাই, দেখো, আমাকে পেলে যাবে না। আমি কিন্তু কাঁদব।
-ঠিক আছে ভাই। তোকে ছাড়া যাব না।
আইরিশ পোস্টার লিখতে শুরু করে। এবার নোরা আর বিরক্ত করে না। দিদিভাইকে পোস্টারে লিখতে দেখে।
পোস্টার লিখতে রাত শেষ হয়ে যায়। রাস্তায় শোনা যায় সেই অমর একুশের গান। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।
আইরিশ বলে, নোরা বাগানে চল। ফুল নেব। বাগান থেকে ফুল নেয়। নোরা বলে, দিদিভাই শহীদদের তাজা ফুল দেব আমরা, কী মজা!
-হ্যাঁ রে ঠিক তাই। চল আর দেরি নয়।
-দিদিভাই, লিওন যাবে না?
-না, লিওন যাবে না। ও হাঁটতে পারবে?
বল!
-সত্যি বলেছ দিদিভাই। লিওন হাঁটতে পারবে না। তবে ও যে কাঁদবে, আমাদের না দেখলে।
-ততক্ষণে আমরা চলে আসব। ওর ঘুম ভাঙবে না তখন।
আইরিশ, নোরা খালি পায়ে বেরোয়।
সেই স্মৃতিমাখা গানটি খুব কাছাকাছি শোনা যায়। আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...