কখনো কখনো বিশ্বের ঘটনা খুব দ্রুত বদলাতে থাকে। কিন্তু যেভাবে ১৯৮৯ সালের ঘটনা এবং ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে, তার সঙ্গে তাল মেলানো কঠিন ছিল। এর একটি হলো বার্লিন দেয়ালের পতন, যা সাড়া জাগিয়েছিল বিশ্ব মহলে।
আমলাতান্ত্রিক একটি দুর্ঘটনায় ওই দেয়ালটি আংশিক ভেঙে পড়ে, কিন্তু এটির পুরোপুরি পতন হয় বিপ্লবীদের এক বিশাল জনস্রোতের কারণে। এর মাধ্যমে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট ব্লকের পতনের শুরু করে এবং নতুন এক বিশ্বের সূচনা হয়।
কীভাবে দেয়ালটি ভেঙে ফেলা হয়? ঘটনাটি ছিল ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর। এর পাঁচ দিন আগে থেকে বিশাল এক প্রতিবাদ সমাবেশের অংশ হিসেবে প্রায় ৫ লাখ মানুষ দেয়ালের পূর্বদিকে জড়ো হয়েছিল, যে দেয়ালটি পশ্চিম জার্মানি থেকে কমিউনিস্ট শাসিত পূর্ব জার্মানিকে আলাদা করে রেখেছিল।
সীমান্তের কড়াকড়ি তুলে দিয়ে এবং পূর্ব জার্মানির বাসিন্দাদের ভ্রমণ সহজ করে দিয়ে বিক্ষোভকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন পূর্ব জার্মানির নেতারা। তবে সীমান্ত পুরোপুরি খুলে দেওয়ার কোনো উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। এসব ছিল ছোট পরিবর্তন। কিন্তু যেভাবে সেটি বাস্তবায়ন করা হয়, তার পরিণতি হয়েছিল ব্যাপক।
ব্যাপক উন্নয়ন সম্পর্কে ব্রায়ান হ্যানরাহানের প্রতিবেদনের কারণে বার্লিন দেয়ালের দ্রুত পতন শুরু হয়। নতুন আইনের বিস্তারিত ঘোষণা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় গুন্টার স্কোহবোঝিকে। কিন্তু নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনের আগে তার সেই ঘোষণা পড়ার সময় ছিল না। তিনি যখন প্রথমবারের মতো ঘোষণাগুলো পড়তে শুরু করেন তখন সাংবাদিকরা হতবাক হয়ে যান। তিনি ঘোষণা করেন, ‘দেশের বাইরে ব্যক্তিগত ভ্রমণের জন্য এখন থেকে আর কোনো পূর্বশর্ত প্রযোজ্য হবে না। বিস্মিত সাংবাদিকরা আরও বিস্তারিত জানার জন্য তখন হইচই শুরু করেন। হাতের নোটগুলো উল্টাতে উল্টাতে স্কোহবোঝি জানালেন, তিনি যতটা জানেন, তাতে অবিলম্বের এ ব্যবস্থা কার্যকর হতে যাচ্ছে। আসলে পরদিন থেকে ওই ব্যবস্থা চালু করার কথা ছিল, যেখানে ভিসার জন্য আবেদনের বিস্তারিত বলা হবে। পূর্ব জার্মানির বাসিন্দারা যখন পশ্চিম জার্মানিতে প্রবেশ করেন, তখন এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। খবরটি দ্রুত টেলিভিশনে ছড়িয়ে পড়ে এবং পূর্ব জার্মানির বাসিন্দারা বিপুল সংখ্যায় সীমান্তে জড়ো হতে শুরু করেন।
ওই সন্ধ্যায় সীমান্তের দায়িত্বে থাকা একজন প্রহরী হারাল্ড জাগের ২০০৯ সালে ডার স্পিগেল পত্রিকাকে বলেন, তিনি বিহুলতার সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনটি দেখছিলেন এবং এরপর দেখতে পেলেন যে, মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। জাগের আতঙ্কিত হয়ে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ফোন করলেন। কিন্তু তারা সীমান্তের গেট খুলে দেওয়া অথবা জনতাকে ঠেকিয়ে রাখতে গুলি করা- কোনো নির্দেশই দিলেন না।
হাতে গোনা কয়েকজন প্রহরীকে নিয়ে শত শত বিক্ষুব্ধ জনতাকে ঠেকাতে অবশ্য শক্তি প্রয়োগ করেও কোনো কাজ হতো না। ধাক্কাধাক্কি করতে গিয়ে বা সেখানে কোনো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে গুলি চালানো ছাড়াই লোকজন আহত অথবা নিহত হতে পারত, তিনি ডের স্পিগেলকে বলেছেন। এ কারণে আমি আমার লোকজনকে আদেশ দিলাম, ব্যারিয়ারটি খুলে দাও। আনন্দ আর কান্না করতে করতে হাজার হাজার মানুষ সেখান দিয়ে ছুটে গেলেন, যে দৃশ্য দেখে সারা পৃথিবীর মানুষের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। অনেকে বার্লিনের ব্রান্ডেনবুর্গ গেট বেয়ে ওপরে ওঠেন, হাতুড়ি আর কুঠার দিয়ে দেয়ালটি ভাঙতে শুরু করেন। এর মাধ্যমে যেন উত্তাল একটি বছর শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছিল। কেন বার্লিনের দেয়ালের পতন শুরু হলো? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার সাবেক মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ইউরোপ বিভক্ত হয়ে যায়। পশ্চিম থেকে আগের দেশগুলোর মধ্যে ধীরে-ধীরে অভেদ্য একটি পর্দা তৈরি করে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
পরাজিত জার্মানি ভাগ হয়ে যায় দখলদার দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে। দেশটির পূর্ব অংশ নিয়ন্ত্রণ করে সোভিয়েতরা। পূর্ব জার্মানি, যার আনুষ্ঠানিক নাম ছিল জার্মান ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক, তখন পশ্চিম ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বিস্তারের কেন্দ্রে পরিণত হয়। তবে বার্লিন ভাগ হয়ে যায় চারটি ভাগে। পশ্চিম অংশে ছিল ব্রিটিশ, ফরাসি এবং আমেরিকান অঞ্চল, আর পূর্ব অংশে ছিল সোভিয়েত এলাকা। পশ্চিম বার্লিন পরিণত হয় চারদিকে কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানি ঘেরা একটি দ্বীপে। আংশিক অবাধ নির্বাচনে সফল হয় পোল্যান্ডের সলিডারিটি মুভমেন্ট। দেয়ালটি অবশ্য নির্মিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে, কারণ তখন পূর্ব বার্লিন থেকে অনেক মানুষ পশ্চিম বার্লিনে চলে যাচ্ছিল।
লেখক : প্রাবন্ধিক