পৃথিবীর বেশির ভাগ সভ্যতা, শহর, নগর গড়ে ওঠে নদীকে কেন্দ্র করেই। বাংলাদেশের মতো নদীমাতৃক দেশের ক্ষেত্রে বিষয়টা আরও প্রাসঙ্গিক। বড় বড় সব শহর, নগর, গঞ্জ কোনো না কোনো নদীর ধারেই গড়ে উঠেছে, নদীকে ব্যবহার করেই বিকশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই জনপদের মানুষের সঙ্গে হাজারো নদ-নদী এমনভাবে মিশে আছে যে নদী না বাঁচলে এই জনপদ বাঁচতে পারবে না, নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। উন্নত দেশগুলো বহু আগেই এই সত্য বুঝতে পেরে তাদের নদীগুলোকে ‘জীবন্ত সত্তা’ বা ‘লিভিং এনটিটি’ হিসেবে বিবেচনা করা শুরু করে। তাদের নদীগুলোকে ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
আমাদের দেশে ২০১৯ সালে উচ্চ আদালত দেশের সব নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা দেন। অর্থাৎ এর পর থেকেই নদীগুলো লিগ্যাল পারসন বা জুরিসটিং পারসন হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আদালতের এ ঘোষণায় মানুষের মতো নদীরও মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। দূষণ ও দখলের মাধ্যমে নদী হত্যাকারী মানবজাতি ও সভ্যতার হত্যাকারী হিসেবে বিবেচিত হবে। উচ্চ আদালতের এ ঘোষণা আশাব্যঞ্জক নিঃসন্দেহে। কিন্তু তার আগেই আমাদের নদ-নদীগুলোর অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। বহু নদ-নদী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অনেকগুলো এখন ধুঁকে ধুঁকে মরার পথে।
আদালতের এই ঘোষণার পরও কি আমরা খুব একটা সচেতন হয়েছি? উত্তরটা হতাশাজনক। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দীর্ঘতম নদ ভৈরবের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়।
নামেই বোঝা যায় একসময় কতটা প্রমত্তা ছিল ভৈরব। যশোরসহ বহু ছোট-বড় নগর, গঞ্জ, বন্দর গড়ে উঠেছে এর দুই পাড়ে। ভাটার সময় পদ্মার মিঠাপানি গড়াই, মাথাভাঙ্গা, ভৈরব হয়ে সাগরে পড়ত। আবার জোয়ারের সময় সাগরের লোনাপানি উঠে আসত ভৈরবে। মিঠাপানি আর লোনাপানি মিশ্রণে মোহনায় গড়ে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন।
ফারাক্কা চালু হওয়াসহ আরও বেশ কিছু কারণে ভৈরবে উজান থেকে মিঠাপানির প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ভৈরবের মরণদশা শুরু হয় মূলত তখন থেকেই। এরপর রয়েছে দখল, আর দূষণ।
ভৈরবকে আমরা এখন গলা চেপে ধরেছি। নদটির শহর অংশে বেশির ভাগ জায়গা দখলদারদের কবলে। নানা আইনি মারপ্যাঁচ কষে তারা এসব জায়গা দখল করে রেখেছে। তা ছাড়া উন্নয়নের নামে কিছুদূর পরপর নদের ওপর তৈরি করা হয়েছে ব্রিজ। দুই পাশ থেকে মাটি ফেলে নদের গলা চেপে ধরে মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে ব্রিজ নামের কয়েক ফুটের ছোট্ট কালভার্ট।
এত সব অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে ভৈরব এখন বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। যশোর শহরের বহু ক্লিনিক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্যরে ভাগাড় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এটি। ভৈরব দূষণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের নামও রয়েছে। যার প্রতিক্রিয়ায় ক্রমেই এর পানি বিষাক্ত হয়ে উঠছে। ভৈরবসহ যশোরের বেশ কয়েকটি নদীর পানি পরীক্ষা করে সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর যে রিপোর্ট দিয়েছে তা আতঙ্কজনক।
পরিবেশ অধিদপ্তরের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী মাছ বা যে কোনো ধরনের জলজ প্রাণী বেঁচে থাকার জন্য নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিজলভড অক্সিজেন বা ডিও) মাত্রা ৫-এর ওপরে থাকতে হবে। অথচ ভৈরব নদের যশোর শহর অংশের দুটি স্থানে ডিও’র মান ৫-এর অনেক নিচে চলে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্প কলকারখানার দূষিত বর্জ্য পানি, বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যমিশ্রিত পানি ক্রমাগত নদীতে পড়তে থাকলে ডিও’র মান এমনিতেই কমে যাবে।
নদীর ধারের প্রতিষ্ঠানগুলোর তরল বর্জ্য সরাসরি যাতে নদীতে না পড়ে, সেজন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ওয়েস্ট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট তৈরির জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাকিদ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। যশোর পৌরসভার সচেতন নাগরিক কমিটির নেতারা বলেছেন, ভৈরব বাঁচাতে দখল ও দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে ভৈরব যেটুকু আছে, সেটুকুও বাঁচানো সম্ভব হবে না। বিষয়টির দিকে নীতিনির্ধারকদের দ্রুত দৃষ্টি দেওয়া দরকার।
♦ লেখক : গণমাধ্যমকর্মী