বাকশক্তি মহান আল্লাহর মহা নিয়ামত। এর মাধ্যমে বান্দা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। পরস্পর যোগাযোগ করতে পারে। মহান আল্লাহর লাখো কোটি নিয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপন করতে পারে।
মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করতে পারে আবার সমাজে কোনো অন্যায় দেখলে তার প্রতিবাদ করতে পারে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাঁর এই মহা মূল্যবান নিয়ামতের কথা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘পরম করুণাময় আল্লাহ, তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন। তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তিনি তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ভাষা।’ (সুরা : আর রহমান, আয়াত : ১-৪)
তাই মহান আল্লাহর দেওয়া মূল্যবান নিয়ামতকে তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবহার করা উচিত। কেননা তিনি যেমন নিয়ামত দিয়েছেন, তেমনি এই নিয়ামত কী কাজে ব্যবহার হচ্ছে, তারও যথাযথ হিসাব রাখছেন। তাঁর নিয়োজিত প্রহরীরা এ অঙ্গের প্রতিটি কার্যক্রম সংরক্ষিত রাখছেন।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে কথাই মানুষ উচ্চারণ করে (তা সংরক্ষণের জন্য) তার নিকটে একজন সদা তৎপর প্রহরী আছে।’ (সুরা : ক্বাফ, আয়াত : ১৮)
তাই মানুষের উচিত কথাবার্তায় সংযত হওয়া। এমন কথা না বলা, যার জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। কেননা কখনো কখনো মানুষের জিহ্বাই তাকে বড় বিপদে ফেলে দিতে পারে। এ জন্য নবীজি (সা.)-এর নিকট এই অঙ্গটি সর্বাধিক আশঙ্কাজনক অঙ্গ ছিল।
হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, সুফিয়ান ইবনে আবদুল্লাহ আস-সাকাফি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমাকে এমন একটি কথা বলুন, যা আমি ধারণ করতে পারি। তিনি বললেন, তুমি বলো, আল্লাহই আমার রব (প্রভু), তারপর এতে সুদৃঢ় থাকো। তিনি (বর্ণনাকারী) বলেন, আমি আবার বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আপনার দৃষ্টিতে আমার জন্য সর্বাধিক আশঙ্কাজনক বস্তু কোনটি? তিনি স্বীয় জিহ্বা ধরে বললেন, এই যে, এটি। (তিরমিজি, হাদিস : ২৪১০)
জিহ্বা দ্বারা মানুষের কত বড় বিপদ সংঘটিত হতে পারে, মানুষ তা কল্পনাও করতে পারে না। এ জন্য নবীজি (সা.) তাঁর উম্মতদের সর্বদা কথাবার্তায় সংযত হওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন। তাঁদের জিহ্বা সংযত রাখার ব্যাপারে সতর্ক করতেন। বিলাল ইবনুল হারিস আল-মুজানি (রা.) নামক রাসুল (সা.)-এর সাহাবি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি : তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি কখনো আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির কথা বলে, যার সম্পর্কে সে ধারণাও করে না যে তা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, অথচ আল্লাহ তাআলা তার এ কথার কারণে তাঁর সঙ্গে মিলিত হওয়ার দিন পর্যন্ত তার জন্য স্বীয় সন্তুষ্টি লিখে দেন। আবার তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি কখনো আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টির কথা বলে, যার সম্পর্কে সে চিন্তাও করে না যে তা কোন পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছবে। অথচ এ কথার কারণে আল্লাহ তাআলা তাঁর সঙ্গে মিলিত হওয়ার দিন পর্যন্ত তার জন্য অসন্তুষ্টি লিখে দেন। (তিরমিজি, হাদিস : ২৩১৯)
এর প্রমাণ ইবলিস শয়তান। একটি বাক্যই তাকে কিয়ামত পর্যন্ত অভিশপ্ত করে দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি বলেন, হে ইবলিস! আমি যাকে আমার দুই হাতে সৃষ্টি করেছি, তার প্রতি সিজদাবনত হতে তোমাকে কিসে বাধা দিল? তুমি কি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলে, না তুমি অধিকতর উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন? সে বলল, আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদা থেকে। তিনি বলেন, তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও, কেননা নিশ্চয়ই তুমি বিতাড়িত। আর নিশ্চয়ই তোমার ওপর আমার অভিশাপ থাকবে, কর্মফল দিন পর্যন্ত।’ (সুরা : সদ, আয়াত : ৭৫-৭৮)
নাউজুবিল্লাহ! কয়েক লাইন কথার বিপদ যে কত বড় হতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ ইবলিসের এই ঘটনা। তাই কথা বলার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক হওয়া এবং অনর্থক কথা পরিহার করা ঈমানের দাবি। রাসুল (সা.) বলেছেন, কোনো ব্যক্তির ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হলো অর্থহীন কথা বা কাজ ত্যাগ করা। (তিরমিজি, হাদিস : ২৩১৮)
আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, কথা হলো ওষুধের মতো, তা কম (পরিমিত) হলে উপকারী, আর বেশি হলে জীবননাশক। (আল এজায ওয়াল ইজায, পৃষ্ঠা-৭৪)
অসংলগ্ন কথার জেরে পৃথিবীতে বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটার নজির রয়েছে। বহু প্রভাবশালী রাজা তাদের অসংলগ্ন কথার কারণে রাজ্য হারিয়েছে, এমনকি জীবনও। যেমন—‘আমি তোমাদের সর্বোচ্চ প্রভু’ দাবি করে ফেরাউন ধ্বংস হয়েছে। ‘আমি জীবন-মৃত্যু দিই’ দাবি করে নমরুদ ধ্বংস হয়েছে।
তাই মানুষকে বিনোদন দেওয়ার উদ্দেশ্যেও এমন কথা বলা উচিত নয়, যেটা পরবর্তী সময়ে বহু বড় বিপদ ডেকে আনার আশঙ্কা রাখে। দুনিয়া ও আখিরাতে লাঞ্ছনার মুখোমুখি করতে পারে। পরিবেশ পরিস্থিতি কখন কাকে কোথায় নিয়ে যায়, কেউ জানে না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বেহুদা কথা খরিদ করে, আর তারা ওগুলোকে হাসিঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে; তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর শাস্তি।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ৬)
কাউকে ছোট করা বা আঘাত করার উদ্দেশ্যেও কথা বলা উচিত নয়। কারণ কিছু কথার আঘাত অন্তরে খুবই গভীর ক্ষত তৈরি করে, যা কখনো শুকায় না। কবি ইয়াকুব হামদুনি বলেছেন, ‘তরবারির ক্ষতের (শারীরিক) আরোগ্য আছে, কিন্তু জিবের দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতের (মানসিক) আরোগ্য নেই।’ (তাজুল উরুস, পৃষ্ঠা-৩৭৩)
আর মুমিন কখনো কাউকে কষ্ট দেওয়ার ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে দোষারোপ করে না, গালাগাল দেয় না। রাসুল (সা.) বলেছেন, মুমিন কখনো দোষারোপকারী, অভিশাপদাতা, অশ্লীলভাষী ও গালাগালকারী হয় না। (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৭৭)
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে কথাবার্তায় সংযমী ও সতর্ক হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।