চলতি বছরের ১০-১৩ জুন লন্ডনে সরকারি সফরকালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের তারিখ নিয়ে আলোচনা করার জন্য তারেক রহমানের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। ২০০৮ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত থাকা তারেক রহমানের সঙ্গে তাঁর দেখা করার সিদ্ধান্ত ইঙ্গিত দেয়, বিদেশে বসবাস করলেও তারেক রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়।
জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন, আর বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। আর তাঁদের ছেলে তারেক রহমানই কার্যত এখন বিএনপির নেতা। সাধারণ নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে ড. ইউনূস লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। সরকার ও বিএনপি উভয়েরই ঘনিষ্ঠ সূত্র অনুসারে, লন্ডনের বৈঠকটি সৌহার্দপূর্ণ ছিল এবং দুই নেতা ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে একমত হন।
বিএনপি আগাম নির্বাচনের জন্য চাপ দিচ্ছিল। দলটি ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে ছিল। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার বলেছিল, বাংলাদেশের সংবিধান, বিচার বিভাগ এবং নির্বাচনি প্রতিষ্ঠানগুলোয় সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার পরই নির্বাচন দেবে। ড. ইউনূস ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন। এতে দেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের চুক্তি হওয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা হয়।
লন্ডনের বৈঠকটি বাংলাদেশে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে এবং দেশব্যাপী এটি উদ্যাপন করা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শূন্য-সমষ্টি রাজনীতি এবং কর্তৃত্ববাদী স্টাইলের কারণে বাংলাদেশে বিভিন্ন দলের নেতাদের একসঙ্গে কাজ করতে খুব কমই দেখা গেছে। তাই ইউনূস-তারেক চুক্তি দুই নেতার দ্বন্দ্ব এড়াতে ইতিবাচকতার ইঙ্গিত দেয়। ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা দ্য ডিপ্লোম্যাটকে জানিয়েছেন, তিনি বিএনপি নেতা তারেক রহমানের ব্যাপারে খুবই মুগ্ধ।
পরিবর্তিত রাজনৈতিক দৃশ্যপটের মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জাগতে পারে। প্রথমত ড. ইউনূসের কেন তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন ছিল এবং দ্বিতীয়ত তারেক রহমানের উত্থানের তাৎপর্য কীভাবে আমাদের বোঝা উচিত?
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার উৎখাতের পরপরই ড. ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়। জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতারা; বিএনপি, যারা রাস্তার বিক্ষোভ কৌশলগত ও স্থিতিস্থাপক করে তুলেছিল; সেনাবাহিনী, যাঁরা শেখ হাসিনার আদেশ অমান্য করে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানো বন্ধ করেছিল, এবং অন্য ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ফলে তাঁর নিয়োগ হয়েছিল।
তবে বিএনপির কিছু অংশের মতামত ছিল, ড. ইউনূস নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না। কারণ তিনি নির্বাচনের জন্য সময়সীমা নির্ধারণ এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। বিশেষত ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা গোষ্ঠীগুলো অনলাইনে যুক্তি দিচ্ছিল যে তাঁর পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা উচিত, যা নির্বাচন সম্পর্কে অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে তোলে।
গত মে মাসে এক বিরল বিবৃতিতে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের এক সভায় বলেছিলেন, বাংলাদেশে ডিসেম্বরেই নির্বাচন করা উচিত। কয়েক দিন পর তারেক রহমানও লন্ডন থেকে ডিসেম্বরে নির্বাচনের জন্য ফোন করেছিলেন এবং বলেছিলেন দেশের মানুষ ‘এ সরকারের অধীনে অবিলম্বে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘সরকারকে জনগণের বৈধ দাবি পূরণ করতে হবে।’
এর পরই ড. ইউনূস পদত্যাগের হুমকি দেন। ক্রমবর্ধমান সমালোচনার মুখে পড়ে ড. ইউনূস ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের জন্য বিএনপির দাবি উপেক্ষা করে ২০২৬ সালের এপ্রিলে নির্বাচন ঘোষণা করেন।
বিএনপি তিনটি কারণে তাঁর সময়সূচি প্রত্যাখ্যান করে। প্রথমত ডিসেম্বরে কেন নির্বাচন হতে পারে না, তার কোনো বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা দেননি ড. ইউনূস, যখন আবহাওয়া মৃদু এবং রাজনৈতিক প্রচারের জন্য উপযুক্ত। দ্বিতীয়ত এপ্রিলে নির্বাচন প্রচারের জন্য কঠিন হবে, কারণ তখন আবহাওয়া খুব গরম থাকে। তা ছাড়া এটি হবে রমজান মাসের পরে, আর রমজানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে বেশির ভাগ মানুষ নামাজ এবং রোজা রাখবে। তৃতীয়ত বিএনপি আশঙ্কা করেছিল, ড. ইউনূস হয়তো এ জটিলতাগুলো নির্বাচন আরও বিলম্বিত করার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করবেন।
ড. ইউনূস ২০২৬ সালের এপ্রিলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ঘোষণা করার পর বিএনপি সূত্র দ্য ডিপ্লোম্যাটকে নিশ্চিত করেছেন, তাঁরা ইউনূসকে নির্বাচন এগিয়ে নিতে চাপ দেওয়ার জন্য দেশব্যাপী একাধিক বিক্ষোভের আয়োজন করবেন। তাই লন্ডনের বৈঠক অস্থিরতা এড়াতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে।
সমালোচকরা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও সহিংসতার অভিযোগ করতেন। ফাঁস হওয়া কূটনৈতিক বার্তা থেকে জানা যায়, আমেরিকান কূটনীতিক জেমস এফ মরিয়ার্টি তারেক রহমানকে ‘ক্লেপ্টোক্র্যাটিক সরকার এবং সহিংস রাজনীতির প্রতীক’ হিসেবে দেখতেন। ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়া এবং কারাদ প্রাপ্ত অনেক বাংলাদেশির মধ্যে তারেক রহমানও ছিলেন। তবে এ অভিযোগ এবং বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করা হয়। প্রকৃতপক্ষে দোষী সাব্যস্ত হওয়া এবং কারাদ পরবর্তীকালে আদালতের মাধ্যমে বাতিল করা হয়। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশে তারেক রহমানের বক্তব্য এবং বিবৃতি সম্প্রচার বা মুদ্রণ নিষিদ্ধ করে। বিএনপি কর্মীদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তার কারণে আওয়ামী লীগের শাসনামলে তারেক রহমানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
২০০১-২০০৬ সালে খালেদা জিয়ার শাসনামলে তারেক রহমান দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করেছিলেন, বিভাগীয় শহর এবং প্রত্যন্ত গ্রামগুলোও বাদ পড়েনি। তিনি তৃণমূলের সঙ্গে একটি শক্তিশালী সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যার ফল ২০১৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে পেয়েছিলেন। উল্লেখ্য, ওই বছর তাঁর মা খালেদা জিয়াকে হাসিনা সরকার গ্রেপ্তার করেছিল।
দীর্ঘদিন বিদেশে থাকা সত্ত্বেও তৃণমূলে তারেক রহমানের সমর্থন রয়েছে। তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্র দ্য ডিপ্লোম্যাটকে জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তিনি দেশের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য হোয়াটসঅ্যাপ এবং জুম ব্যবহার করেছেন। তিনি তাঁদের পরিবারের সদস্যদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। একজন সাধারণ বিএনপি কর্মীর কাছে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, যিনি দেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ছেলে, তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথোপকথনের সুযোগ ছিল উৎসাহজনক এবং গর্বের।
তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের সঙ্গে এ ধরনের সরাসরি কথোপকথন তারেক রহমানকেও বাস্তবতা সম্পর্কে অন্তর্র্দৃষ্টি দিয়েছে এবং তাঁর রাজনৈতিক কৌশল গঠনে সহায়তা করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর দমনপীড়ন সত্ত্বেও তৃণমূল পর্যায়ে তাঁর জনপ্রিয়তার কারণে বিএনপি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
১৫ বছরের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপি নেতা-কর্মীদের গণবন্দি, নির্যাতন, গুম এবং সমর্থকদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের মাধ্যমে দলটি ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ তারেক রহমান কেবল আওয়ামী লীগের শাসনামলে নির্যাতিত বিএনপি সদস্যদের পরিবারকে নীরবে সমর্থন করেননি, বরং তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের গণতন্ত্রের জন্য এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছিলেন। পুরস্কারপ্রাপ্ত অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক তাসনিম খলিলের মতে ‘তারেক রহমানের সাংগঠনিক নেতৃত্ব উচ্চমানের। তিনি তৃণমূলের ভাষায় কথা বলেন।’ খলিলের দৃষ্টিতে, তারেক রহমান হলেন ভবিষ্যতের উদার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য সেরা বাজি। কারণ খলিল বিশ্বাস করেন, ইউনূসের শাসনামলে ডান ও কট্টর ইসলামপন্থিরা প্রভাব বাড়াতে পেরেছে।
তারেক রহমানের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হলো, বাংলাদেশে ফিরে আসার পর তাঁকে লাখ লাখ নতুন বাংলাদেশি ভোটারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। শেখ হাসিনার পতনের পর বিএনপি কর্মীদের মধ্যে খুনের ঘটনা এবং কিছু বিএনপি নেতা-কর্মীর চাঁদাবাজির খবর পাওয়া গেছে। এর ফলে তরুণদের মধ্যে বিএনপি অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে তারেক রহমান হাজার হাজার কর্মীকে বেআইনি কর্মকাণ্ডের জন্য বহিষ্কার করেছেন।
অনেকে যুক্তি তুলে ধরেছেন এভাবে-বিএনপির দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তারেক রহমানের বাংলাদেশে ফিরে আসা উচিত। তবে বিএনপির ঘনিষ্ঠরা বলছেন, তারেক রহমান। দ্রুতই ফিরবেন না। তাঁরা ডিপ্লোম্যাটকে বলেছেন, ইউনূস সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার পর নির্বাচনি প্রচারে অংশ নিতে তিনি ফিরে আসবেন।
তারেক রহমানের চ্যালেঞ্জ হলো, বিএনপিকে জেনজিদের সঙ্গে সংযুক্ত করা, যাঁরা গত বছর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এ তরুণ ভোটারের অনেকেই বিএনপির সমালোচনা করেন। কারণ তাঁরা মনে করেন, বিএনপির কিছু কর্মী অপরাধমূলক কর্মকা ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত।
তারেক রহমানকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল আওয়ামী লীগের দুর্নীতি ও সহিংসতা। তাঁকে বিএনপির জন্য একটি ভিন্ন পথ বেছে নিতে হবে।
(এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিখ্যাত সাময়িকী ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ ১৫ জুলাই তার অনলাইন সংখ্যায় ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের তারেক রহমানের উত্থান’ শিরোনামে নিবন্ধটি প্রকাশ করে। নিবন্ধটির লেখক সিডনিভিত্তিক গবেষক ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভূরাজনীতি বিশ্লেষক মোবাশ্বার হাসান)