বিশ্বে প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্যে এমন আটটি শিশু জন্ম নিয়েছে, যাদের ডিএনএ এসেছে তিনজনের শরীর থেকে—মা-বাবার পাশাপাশি এক ডোনার নারীর। এই বিপ্লবাত্মক চিকিৎসা পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হলো, মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগ প্রতিরোধ করা। যা সাধারণত মায়ের দেহ থেকে সন্তানের দেহে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে শিশুর জন্মের কিছু দিনের মধ্যেই মৃত্যু ঘটায়।
এই যুগান্তকারী পদ্ধতিটি বিজ্ঞানীরা ব্রিটেনে প্রায় এক দশক আগে আবিষ্কার করেন এবং ২০১৫ সালে এটি আইনি বৈধতা পায়। তবে এই প্রথমবার জানা গেল যে, এই পদ্ধতিতে জন্ম নেওয়া শিশুরা প্রকৃতই মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগ থেকে মুক্ত।
নিউক্যাসল ফার্টিলিটি সেন্টারের অধীনে পরিচালিত এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে অংশ নেওয়া কোনো পরিবার এখনো প্রকাশ্যে আসেনি। তারা সকলেই গোপনীয়তা বজায় রাখতে চায়। তবে তারা কেন্দ্রের মাধ্যমে কিছু আবেগঘন বিবৃতি দিয়েছে।
‘আশা পেয়েছিলাম, আর এখন পেয়েছি আমাদের সন্তান’
একজন মা বলেন, “বছরের পর বছর অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটানোর পর এই চিকিৎসা আমাদের নতুন করে আশার আলো দেখিয়েছিল। আর আজ আমরা আমাদের মেয়েকে দেখতে পাচ্ছি, প্রাণে ভরপুর—এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।”
আরেকজন বাবা-মা জানান, “এই অসাধারণ অগ্রগতি ও প্রাপ্ত সহায়তার জন্যই আমাদের পরিবার এখন সম্পূর্ণ। মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগের যে মানসিক ভার আমাদের কাঁধে ছিল, তা এখন উঠে গেছে। তার জায়গায় এসেছে আনন্দ, স্বস্তি আর কৃতজ্ঞতা।”
কীভাবে কাজ করে এই তিন-ডিএনএ প্রযুক্তি?
মানুষের শরীরে প্রায় প্রতিটি কোষে থাকে মাইটোকন্ড্রিয়া—ক্ষুদ্র একক যা অক্সিজেন ব্যবহার করে খাবারকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে। এই শক্তিই শরীরের সমস্ত কার্যাবলী চালিয়ে যায়। কিন্তু যদি মায়ের মাইটোকন্ড্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাহলে তা সন্তানের দেহে গিয়ে মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগ সৃষ্টি করে। এতে শিশুর হৃদস্পন্দন থেমে যেতে পারে, হতে পারে স্নায়বিক জটিলতা, অন্ধত্ব, পেশিশক্তি হ্রাস এবং অঙ্গ বিকল হওয়ার মতো মারাত্মক সমস্যা।
প্রতি ৫ হাজার শিশুর মধ্যে একজন এই রোগে আক্রান্ত হয়ে জন্মায়। অনেক পরিবার এর ফলে একাধিক সন্তান হারিয়েছে। বিশে প্রক্রিয়ায় নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে বের করে নেওয়া হয়। তারপর ধাপে ধাপে সারা হয় এই প্রক্রিয়া।
ফলে শিশুটি তার অধিকাংশ জেনেটিক বৈশিষ্ট্য—যেমন চোখের রঙ, উচ্চতা, আচরণ—পায় মা-বাবা থেকে, কিন্তু প্রায় ০.১% জেনেটিক উপাদান আসে ডোনার নারীর মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে।
‘শিশুদের শরীরে মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগ নেই’
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত দুটি গবেষণায় বলা হয়, এ পর্যন্ত ২২টি পরিবার এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। এতে জন্ম নিয়েছে চারটি ছেলে ও চারটি মেয়ে, যার মধ্যে একটি যমজ জুটি রয়েছে এবং একটি গর্ভধারণ এখনো চলছে।
অংশ নেওয়া সকল শিশুই মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগমুক্ত এবং প্রত্যাশিত শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ধাপ অতিক্রম করেছে। একটি শিশুর হালকা এপিলেপ্সি ধরা পড়লেও তা নিজে থেকেই সেরে যায় এবং একটি শিশুর হৃৎস্পন্দনে সামান্য সমস্যা রয়েছে, যা চিকিৎসায় নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এগুলোর সঙ্গে মাইটোকন্ড্রিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
ভবিষ্যতের আশা
গবেষণায় দেখা গেছে, পাঁচটি শিশুর ক্ষেত্রে মায়ের ত্রুটিপূর্ণ মাইটোকন্ড্রিয়া একেবারেই সনাক্ত করা যায়নি। বাকি তিনটির ক্ষেত্রে ৫ থেকে ২০ শতাংশ মাইটোকন্ড্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ পাওয়া গেছে—যা ৮০ শতাংশের নিচে থাকলে সাধারণত রোগ সৃষ্টি করে না। এটি নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেরি হারবার্ট বলেন, এই ফলাফল আমাদের আশাবাদী করে তুলছে। তবে প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা বুঝতে আরও গবেষণা আবশ্যক, যাতে ভবিষ্যতে আরও ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
নৈতিক বিতর্ক ও সম্ভাবনা
তবে প্রযুক্তিটি নিয়ে বিতর্ক একেবারে থেমে নেই। কারণ মাইটোকন্ড্রিয়া নিজেই একটি ক্ষুদ্রতর ডিএনএ বহন করে এবং এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মেও বহনযোগ্য। মেয়ে শিশুরা এটি ভবিষ্যতের সন্তানদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে। ফলে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, এটি জেনেটিক মডিফিকেশন বা ‘ডিজাইনার বেবি’র দিকে একধরনের পদক্ষেপ হতে পারে।
কিন্তু এ সমস্ত বিতর্কের মাঝেও যুক্তরাজ্য এই প্রযুক্তির পথিকৃত হিসেবে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। অধ্যাপক স্যার ডগ টার্নবুল বলেন, এই সাফল্য কেবল যুক্তরাজ্যেই সম্ভব হয়েছে; বিশ্বমানের বিজ্ঞান, সংসদীয় আইন, এনএইচএস’র সহায়তা এবং এর ফলাফল—আটটি সুস্থ শিশু। এর চেয়ে আনন্দজনক কিছু হতে পারে না।
লিলি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা লিজ কার্টিস বলেন, বছরের পর বছর অপেক্ষার পর এখন নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এই পদ্ধতিতে জন্ম নেওয়া আটটি শিশুর কেউই মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগে আক্রান্ত নয়। অনেক পরিবারের জন্য এটি এই রোগের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলার প্রথম বাস্তব আশার প্রদীপ।
সূত্র: বিবিসি
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল