দুই-চারটি গাছ লাগিয়ে কোটিপতি হওয়া যায়? শুনতে হাস্যকর মনে হলেও এমন আশ্বাস মিলছে বৃক্ষমেলায়। লটারি নয়, কয়েকটি চন্দন গাছ বদলে দিতে পারে ভাগ্য। আর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রসংলগ্ন সাবেক বাণিজ্য মেলার মাঠে চলমান মাসব্যাপী বৃক্ষমেলায় মিলছে শ্বেতচন্দন ও রক্তচন্দনের চারা। দামও লাখ টাকা নয়, ১ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় মিলছে এ মূল্যবান গাছ, ৩০ বছরে যার একটির দাম হতে পারে কোটি টাকা।
শুধু চন্দন নয়, মেলাতে শুষ্ক মরুর নানা জাতের খুরমা খেজুরের চারাও দৃষ্টি কাড়ছে দর্শনার্থীদের। সেসব গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে আজোয়া, মরিয়মসহ নানা জাতের খেজুর। এসব খেজুর গাছের চারা এক থেকে চার হাজার টাকায় মিললেও ফলসহ গাছ কিনতে চাইলে গুনতে হবে ৭০ হাজার থেকে লাখ টাকা। বৃক্ষমেলায় বিশাল এলাকাজুড়ে গাছে গাছে ঝুলছে আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, লিচু, বেল, লটকন, লংগান, খুরমা খেজুর, মাল্টা, সুইট লেমন, রাম্বুটান, ত্বীন, কমলা, সফেদা, ডালিমসহ শত শত প্রজাতির ফল। আছে বিভিন্ন প্রজাতির আঙ্গুর, এফ্রিকট, কিউই, জাবাটিকাবা, চেরি, হাজারি নারকেল, ভিয়েতনামি নারকেল, কেরালার নারকেল, কদবেল, করমচাসহ হরেক প্রজাতির ফলের চারা। আছে বনজ, ঔষধি, সৌন্দর্যবর্ধকসহ হাজারও প্রজাতির দেশি-বিদেশি গাছ। ৫০ টাকা থেকে শুরু করে লাখ টাকা দামের গাছও রয়েছে মেলায়।
গত ২৫ জুন বৃক্ষমেলা-২০২৫ উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মেলা চলবে আগামী ২৪ জুলাই পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত মেলা প্রাঙ্গণ। মেলায় ঢুকতে লাগছে না প্রবেশ মূল্য। রয়েছে বিনামূল্যে গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা। মেলায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন বৃক্ষপ্রেমীরা। অফিস থেকে ফেরার পথে অনেকেই ঢুঁ মারছেন। হাতে করে বা গাড়ির ব্যাকডালায় ভরে গাছ নিয়ে ফিরছেন বেলকনি বা ছাদের জন্য।
মেলায় কিশোরগঞ্জ নার্সারি, সৌদি খেজুর নার্সারিসহ কয়েকটি স্টলে চন্দন গাছের চারা দেখা গেছে। সৌদি খেজুর নার্সারির ‘চন্দন ফার্ম’ নামে আলাদা একটি প্রকল্প আছে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মুহাম্মদ আবদুল হালিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গাছ শুধু পরিবেশ রক্ষাই করে না, মানুষের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। একটি চন্দন গাছ ১৫ বছরেই ১০-১২ লাখ টাকা দাম হয়ে যেতে পারে। ভালো পরিবেশ পেলে ৩০ বছরে একটি গাছের দাম কোটি টাকাও হয়ে যেতে পারে। আমরা ভারত থেকে বীজ এনে রক্তচন্দন ও শ্বেতচন্দনের চারা করতাম। বর্তমানে ভারত থেকে বীজ আসা বন্ধ থাকায় দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আনার চিন্তা করছি। এখন যেসব চন্দনের চারা আছে তার প্রতিটির দাম ১ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। চন্দন গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খেলাল রাখার পরামর্শ দেন আবদুল হালিম। তিনি বলেন, দুই চন্দনই মূল্যবান। এ গাছের খুব যত্ন নেওয়া লাগে না। তবে শ্বেতচন্দন লাগানোর সময় পাশে সঙ্গী গাছ লাগাতে হয়। তা ঝাউ গাছ হতে পারে, নিম গাছ হতে পারে। গোড়ায় ঝোপঝাড় থাকা ভালো। সঙ্গী না পেলে শ্বেতচন্দন কম বড় হয়। রক্তচন্দনের সঙ্গী লাগে না। এ ছাড়া খুরমা খেজুর গাছও পাশাপাশি স্ত্রী ও পুরুষ গাছ লাগাতে হয়। না হলে ফল ঝরে যায়।
বর্তমানে চলছে আম-কাঁঠালের মৌসুম। গাছ থেকে নিজ হাতে এসব ফল পেড়ে খাওয়ার সৌভাগ্য রাজধানী ঢাকার খুব কম মানুষেরই হয়। তবে বৃক্ষমেলায় এক মাসের জন্য মিলছে সেই সুযোগ। তবে এজন্য ক্রেতাকে কিনতে হবে পুরো গাছ। এ ছাড়া ঢাকায় বড় গাছ লাগানোর মতো জমি খুব কম মানুষের থাকায় ফ্ল্যাটবাসার বাসিন্দারা মূলত ফুল গাছ, ক্যাকটাস, পাতাবাহার, বেগুন, মরিচ, ক্যাপসিকামের মতো ছোট গাছ কিনছেন। যাদের ছাদ বা কিছুটা জমি আছে তারা বিভিন্ন ফল গাছ কিনছেন।
অনেক সচেতন অভিভাবক কর্মব্যস্ত জীবন থেকে কিছুটা সময় বের করে পরিবার নিয়ে ঢুঁ মারছেন বৃক্ষমেলায়। ইট-পাথরের নগরে ফ্ল্যাটবাসায় বেড়ে ওঠা সন্তানকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন বিভিন্ন গাছের সঙ্গে। শিশুরাও প্রাণপ্রকৃতির এ ভিন্ন জগতে এসে আনন্দে আত্মহারা। দৌড়ে দৌড়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছের কাছে যাচ্ছে। বাবা-মাকে জিজ্ঞাসা করছে গাছটির নাম। অধিকাংশ দর্শনার্থী এসব গাছের সঙ্গে ছবি তুলছেন। ভিডিও করে নিয়ে যাচ্ছেন।
মেলায় শতাধিক নার্সারির পাশাপাশি রয়েছে হস্তশিল্পের দোকান, গাছের ওষুধ ও সারের দোকান, তথ্য কেন্দ্র, খাবারের দোকান, ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার, বয়স্কদের বসার স্থান, হারবাল ওষুধের দোকানসহ বৃক্ষপ্রেমীদের জন্য সব আয়োজন। গাছের পাশাপাশি বীজ, সার, মাটি, কীটনাশক, টব, ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন, টব বা গাছ রাখার বিভিন্ন আসবাবপত্রও বিক্রি করা হচ্ছে।
মেলা ঘুরে ফলদ গাছের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে বিভিন্ন প্রজাতির আম। ছোট ছোট গাছে দৃষ্টি কাড়ছে থোকায় থোকায় ধরে থাকা বিভিন্ন রঙের ও আকারের আম। এর মধ্যে ক্রেতাদের সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করছে ব্রুনাই কিং জাতের আম গাছ। কয়েক ফুট উচ্চতার এসব গাছে ঝুলে আছে ৩-৪ কেজি ওজনের আম। ডকমাই সি মুয়াং, ব্যানানা আম, কিং চাকাপাত, সূর্যডিম আমসহ আরও হরেক রকমের বাহারি আম দর্শনার্থীর দৃষ্টি কাড়ছে। আঁঠাবিহীন কাঁঠাল গাছের প্রতিও ক্রেতাদের আগ্রহ দেখা গেছে।
মেলায় স্টলগুলোতে আউটডোর প্ল্যান্টের পাশাপাশি রয়েছে স্নেক প্ল্যান্ট, পিস লিলি, স্পাইডার প্ল্যান্ট, অ্যালোভেরাসহ বিভিন্ন উপকারী ইনডোর প্ল্যান্ট। বিক্রেতারা জানান, এসব ইনডোর প্ল্যান্ট ঘরের বাতাস বিশুদ্ধ রাখে। এ গাছগুলো ঘরের ভিতরে থাকা কার্বন মনোক্সাইড, ফর্মালডিহাইড এবং অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ শোষণ করে বাতাসকে পরিষ্কার করে। তারা কোন গাছের কী উপকারিতা তা দর্শনার্থীদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন।