গত ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর কাওলা রেলগেট এলাকায় ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া সোনার বাংলা এক্সপ্রেসের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান অংকিতা মজুমদার নামে এক নারী। গত ২ মে খিলক্ষেত এলাকার রেলক্রসিং পার হতে গিয়ে কমলাপুরগামী সুরমা মেইল ট্রেনে কাটা পড়ে ঘটনাস্থলে মারা যান ২৫ বছর বয়সি যুবক। শুধু ওপরের ঘটনাই নয়, প্রায়ই রেলক্রসিং কিংবা রেললাইন পার হতে গিয়ে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। কিছুদিন আগে ঢাকার কুড়িলে ট্রেনের ভিডিও করতে গিয়ে আরেক ট্রেনের নিচে পড়ে এক তরুণ প্রাণ হারিয়েছেন। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে রেললাইনে বসে গল্প করছিলেন তিন বন্ধু। কথার ফাঁকে কখন যে ট্রেন ধেয়ে এলো কেউ বুঝে ওঠার আগেই তাদের জীবন থেমে গেল। গত ২ মে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ক্যান্টনমেন্ট স্টাফ রোড এলাকায় ধূমকেতু এক্সপ্রেস ট্রেনে কাটা পড়ে ৬০ বছর বয়সি এক নারী মারা যান। এ মর্মান্তিক ঘটনা নতুন নয়। একদিকে মনোযোগ, অন্যদিকে অসতর্কতা-এ দুয়ের ফাঁদে পড়ে রেললাইনে কাটা পড়ার ঘটনা যেন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জানা গেছে, অসচেতনতা ও অবৈধ রেলক্রসিং এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার মূল কারণ। এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৭৯ শতাংশ রেলক্রসিং অরক্ষিত। অর্থাৎ ট্রেন চলাচলের সময় গাড়ি আটকানোর মতো কোনো পাহারাদার নেই, এমন কোনো ব্যবস্থা নেই যেটা থেকে দুর্ঘটনা রোধ করা যায়। ফলে একেকটি রেলক্রসিং যেন মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রেলক্রসিংগুলোর বিরাটসংখ্যক রেলক্রসিং অনুমোদিত। এসব রেলক্রসিংয়ের কোথাও গেট নেই। আবার নেই গেটম্যান। রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে। প্রতিবছর সারা দেশের রেলক্রসিংয়ে দুই শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যাও তার বেশি। এর মধ্যে ৮৯ শতাংশ দুর্ঘটনার উৎস লেভেল ক্রসিং। গত প্রায় চার বছরে সারা দেশে রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১ হাজার মানুষ। আহত ও পঙ্গু হয়েছেন দেড় হাজারের বেশি মানুষ। গত ১৬ বছরে রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন সহস্রাধিক। এর মধ্যে শুধু লেভেল ক্রসিংয়েই মৃত্যু হয়েছে ৬৫০ জনের। রেল দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি হয় তার ৮৯ শতাংশই অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে ঘটে। রেলওয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা দেশে রেলপথে মোট ক্রসিং আছে ২ হাজার ৮৫৬টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬১টিরই অনুমোদন নেই। আবার ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ ক্রসিংয়ের মধ্যে ৬৩২টি ক্রসিংয়েই গেটম্যান নেই। এর মধ্যে মাত্র ২৪২টিতে রেলের স্থায়ী রক্ষী রয়েছে। আর ৮২০টিতে রয়েছে চুক্তিভিত্তিক রেলরক্ষী, যা মাত্র ৩১ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেল চলাচলের নিরাপত্তা রক্ষায় দেশের প্রচলিত আইনও রয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে আইন অনুযায়ী, রেললাইনের দুই পাশে ১০ ফুট পর্যন্ত এলাকা সবসময়ই ১৪৪ ধারা জারিকৃত এলাকা হিসেবে গণ্য হয়। সেখানে কারও অবস্থান বেআইনি। আইন অমান্য করলে গ্রেপ্তারও করা যায়। এমনকি গবাদি পশু ওই এলাকায় প্রবেশ করলে সেটাও জব্দ করে বিক্রির বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আইন শুধু কাগজেই থেকে যাচ্ছে। বাস্তবতা হলো- মানুষ এ আইন জানেও না, মানেও না। আর এ অমান্যতার ফল হলো মৃত্যু। একটি ছবি তুলতে, কল ধরতে ও কিছু সময় গল্প করতে গিয়ে অকালে হারাচ্ছে প্রাণ।