১০ জুলাই তীব্র আকার ধারণ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গত বছরের এই দিন দুপুরে কোটার বিষয়ে সব পক্ষকে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ জারি করেন হাই কোর্টের আপিল বিভাগ। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন আন্দোলনকারীরা। রায় প্রত্যাখ্যান করে সরাসরি সরকারের কাছে কোটার সমাধান চান তারা। শাহবাগে স্লোগান ওঠে ‘হাই কোর্ট না শাহবাগ? শাহবাগ শাহবাগ’, ‘কোটা নাকি মেধা আগে, জবাব চাই শাহবাগে’। ৬ জুলাই থেকে শুরু হওয়া বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি এদিন ব্যাপক আকার ধারণ করে। অচল হয়ে পড়ে পুরো দেশ। সারা দেশ থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা।
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বিভাগ চার সপ্তাহের জন্য কোটার জন্য স্থিতাবস্থা জারি করেন। পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করে আদালত থেকে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বলা হয়, যার যার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে গিয়ে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করার জন্য। রায় প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সরকারি চাকরির সব গ্রেডে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা বহাল করে অন্য সব কোটা বাতিলের দাবিতে পূর্ব ঘোষিত ‘সর্বাত্মক ব্লকেড’ কর্মসূচি জারি রাখেন তারা।
সড়ক-মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ। অবরুদ্ধ রেলপথ। ১০ জুলাই রাজধানীর শাহবাগ, ফার্মগেট, ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, নীলক্ষেত, সায়েন্সল্যাব মোড়, কাকরাইল, পল্টন, পরীবাগ, চানখাঁরপুল মোড়, গুলিস্তান, মহাখালী, আগারগাঁও মোড়ে বিক্ষোভ করে আন্দোলনকারীরা। এ ছাড়া ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর, বরিশালসহ সারা দেশে বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
এদিন সর্বাত্মক ব্লকেডে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে আটকা পড়েন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বিদায়ি রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি। পরে সড়কে কিছু সময় হেঁটে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে তৎকালীন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান তিনি।
এদিন সকাল থেকেই শাহবাগ, কারওয়ানবাজার, ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, ফার্মগেটসহ বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নিয়ে অবরোধ শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। নীলক্ষেত ও সায়েন্সল্যাব মোড় অবরোধ করেন ঢাকা কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা। গুলিস্তানের জিপিও মোড় অবরোধ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীরা। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবরোধ করেন আগারগাঁও মোড়। মহাখালীতে রেলপথ ও সড়কপথ অবরোধ করেন সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা।
শহরের বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে হাডুডু, ক্রিকেট, ফুটবল খেলায় মেতে উঠতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। কেউ কেউ চাকরির পরীক্ষার বই হাতে পড়তে বসে যান আন্দোলনকারীদের সঙ্গে। কবিতা, গান, নানা রকম প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, পতাকা হাতে কোটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান তারা। অনেকে ২০১৮ সালের মতো কোটা বিরোধী বডি গ্রাফিতি ও কাফনের কাপড় পরেও হাজির হন আন্দোলনে।
সর্বাত্মক বাংলা ব্লকেড আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে ঢাকার বাইরেও। সকাল থেকেই ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। চট্টগ্রামে রেল ও সড়কপথ অবরোধ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অধিভুক্ত কলেজ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। সকাল ১০টায় চবির শাটল ট্রেনে চড়ে ১৭ কিলোমিটার দূরে দেওয়ান হাটে আসেন শিক্ষার্থীরা। অবরোধ করেন দেওয়ান হাট রেলপথ। দুপুর ১টার দিকে চট্টগ্রামের টাইগারপাস এলাকা অবরোধ করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
বৃষ্টি উপেক্ষা করে সকাল থেকে দড়ি টেনে ও গাছের খুঁটি ফেলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজসহ কুমিল্লার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা।
সকাল থেকে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ও রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলনে বন্ধ হয়ে যায় রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী সব যান চলাচল। গাছের গুঁড়ি ও বেঞ্চ দিয়ে কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
খুলনা-যশোর মহাসড়কের নতুন রাস্তা মোড়ে অবরোধ করেন সরকারি ব্রজলাল কলেজ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত কলেজ শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া বেনাপোল থেকে আসা একটি ট্রেনও আটক করে শিক্ষার্থীরা।
রেলপথ অবরোধ করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা। বেলা ১১টার দিকে দেওয়ানগঞ্জগামী তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনটি অবরোধ করেন তারা। এতে বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে ট্রেন চলাচল। সর্বাত্মক ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থীরা। ঢাকা-পাবনা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ-ভৈরব সড়কের বড়পুল মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। মাদারীপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা অবরোধ করেন মাদারীপুর-শরীয়তপুর সড়কের ডিসি ব্রিজ এলাকা। টাঙ্গাইল-নাগরপুর-আরিচা আঞ্চলিক সড়কের কাগমারী মোড় অবরোধ করেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়ক অবরোধ করেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক অবরোধ করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা।