ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা যখন বুক পেতে দিয়েছিল তখন সেনাবাহিনীই ছিল একমাত্র ভরসা। বিগত ১১ মাসে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনী যখন অসহায় তখন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় সেনাবাহিনী। দীর্ঘ সময় ব্যারাকের বাইরে থেকে দেশসেবায় আত্মনিবেদিত আমাদের সশস্ত্র বাহিনী। গতকাল গোপালগঞ্জে যে বর্বরোচিত ঘটনা ঘটল তাতে আবারও প্রমাণ হলো সংকটে সেনাবাহিনীই ভরসা। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ ও আখতার হোসেন সংঘাতময় পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানে (এপিসি) করে গোপালগঞ্জ ছাড়েন। প্রথমে তাঁরা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অবস্থান নেন। সেখান থেকে সেনাবাহিনী তাদের উদ্ধার করে নিরাপদে গোপালগঞ্জ ছাড়ার ব্যবস্থা করেন। তার আগে সেখানে এনসিপির সমাবেশে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালালে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন।
সংকটে সহায়তার জন্য সেনাবাহিনীর এই ভূমিকার উদাহরণ অনেক। গত বছর ২৫ আগস্ট সচিবালয়ে হাসনাত আবদুল্লাহসহ ৫০ জন শিক্ষার্থী আন্দোলনরত আনসার সদস্যদের হামলার শিকার হন। সে সময়ও সেনাবাহিনী তাদের উদ্ধারে এগিয়ে যায়। হাসনাত আবদুল্লাহসহ গুরুতর আহত শিক্ষার্থীদের ঢাকার সিএমএইচে ভর্তির ব্যবস্থা করে। কিন্তু দেড় মাস আগেও এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম সেনাবাহিনীর অবস্থান ও কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। রংপুরে জাতীয় পার্টির নেতা জি এম কাদেরের বাড়িতে হামলা প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, ‘পুরোনো বাইক আর সামান্য আগুন নিয়ে যাদের এত চিন্তা তারা বিগত ৯ মাসে আওয়ামী সন্ত্রাসী খুনিদের ধরতে কয়টা অভিযান চালিয়েছে? কতজনকে গ্রেপ্তার করেছে?’
সেনাবাহিনীকে নিয়ে বিশেষ মহলের এমন প্রশ্নের ঘটনা ওই একটিই নয়। এনসিপির আরেক নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ গত মার্চে নিজের ফেসবুকে সেনাপ্রধানকে ইঙ্গিত করে বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করেন। বিষয়টি তাঁর নিজের দলকেই অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। এনসিপির আরেক নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী হাসনাতের ওই ফেসবুক স্ট্যাটাস ‘শিষ্টাচারবর্জিত’ হয়েছে বলে এক দিন পর মন্তব্য করেন। হাসনাত আবদুল্লাহর পোস্টের কাছাকাছি সময়ে অন্তর্র্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও সেনাপ্রধানকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন। তবে সেনাবাহিনী এসব বিষয়ে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। হাসনাত আবদুল্লাহর শিষ্টাচারবর্জিত মন্তব্যের বিষয়ে সেনাসদরের বক্তব্য হিসেবে সুইডেনভিত্তিক একটি সংবাদমাধ্যম নেত্রনিউজ জানায়, ‘হাসনাতের বক্তব্য অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ব গল্পের সম্ভার’।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর সেনাপ্রধান বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেশ গঠনে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, আমি সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে হস্তক্ষেপ করতে দেব না- এটা আমার স্পষ্ট অঙ্গীকার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং পরবর্তী সময়ে দেশসেবায় সেনাবাহিনীর ভূমিকার ব্যাপক প্রশংসা করেন। গত ৬ অক্টোবর সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে ‘সেনা সদর নির্বাচনি পর্ষদ ২০২৪’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘দেশের ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং একটি অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে দেশকে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করেছে। ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আবারও দেশের মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।’