১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত ভাগ হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। দেশভাগ নিয়ে সে সময়ের আলোচিত স্লোগান ছিল ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। তারপর বায়ান্ন, ঊনসত্তর, সত্তর, একাত্তরে অনেক আলোচিত স্লোগান ছিল। ওই সময়ের মধ্যে বহুল আলোচিত সেøাগানগুলোর অন্যতম ছিল ‘পিন্ডি না ঢাকা- ঢাকা ঢাকা’। ঊনসত্তরে এটি প্রায় সবার মুখে মুখে ফিরত। স্লোগানটি স্বাধীনতাসংগ্রাম পর্যন্ত জাতিকে আলোড়িত করেছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর ‘পিন্ডি’ শব্দটি আবার স্লোগানে উচ্চারিত হচ্ছে। পিন্ডির সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে ‘রাজাকার’ শব্দটি। বাংলাদেশের জন্য দিল্লি ও পিন্ডি দুটি শব্দই খুব স্পর্শকাতর। সোমবার ঢাকার রাজপথসহ সারা দেশে বিএনপি নেতা-কর্মীদের আলোচিত স্লোগান ছিল ‘দিল্লি গেছে স্বৈরাচার, পিন্ডি যাবে রাজাকার’। সাধারণভাবে এটি শুধু স্লোগান মনে হলেও এর মধ্যে অনেক বড় রাজনীতি আছে। একটু দেরিতে হলেও স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া, জাতীয়তাবাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল বেগম খালেদা জিয়া এবং সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমানের রক্তের উত্তরসূরি তারেক রহমানের দল বিএনপি সেই রাজনীতিটা বুঝতে পেরেছে; এটাই হলো এ মুহূর্তে বিএনপির রাজনীতির সুখবর। তবে এ উপলব্ধি শুধু রাজপথে স্লোগানে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। বিএনপির প্রত্যেক নেতা-কর্মীকে এ চেতনা ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি তাদের প্রত্যেককে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ হতে হবে। ডিজিটাল দুনিয়ার সব অপপ্রচারের উপযুক্ত জবাব দিতে হবে। তা না হলে আগামী নির্বাচনি যুদ্ধে ডিজিটাল অপপ্রচারে কাবু হয়ে যাবে বিএনপি। কদিন আগে পুরান ঢাকায় সোহাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাজনীতিতে নেতাদের চরিত্রহননের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এটা সুখকর পরিস্থিতি নয়। এদিকে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক চুক্তি নিয়েও শঙ্কা বাড়ছে। দুই দফা আলোচনা শেষে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে তেমন কিছুই বললেন না। শুধু বললেন, নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট তিনি প্রকাশ করবেন না। তাঁর এ বক্তব্যে সরকারের প্রতি সংশ্লিষ্ট মহলের সন্দেহ-সংশয় বাড়ছে।
বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক মৈত্রী খুব বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। রাজনীতির প্রতিটি বাঁকে এর ধরন বদলায়। গতিপথ বদলায়। চরিত্রও বদলায়। স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণের কারণে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। আরেকবার নিষিদ্ধ করেন তার কন্যা শেখ হাসিনা। কিন্তু জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্রের সুবাতাসে জামায়াত নতুন করে রাজনীতি করার সুযোগ পায়। সেই থেকে বিএনপির সঙ্গে মধুর ও বোঝাপড়ার একটি সখ্য গড়ে ওঠে। কিন্তু আস্থার জায়গাটা বারবার হোঁচট খাচ্ছে। শেখ হাসিনার শাসনামলের ১৬ বছর এ দুটি দলই নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকেও জেল খাটতে হয়েছে। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও তিনি উন্নত চিকিৎসা পাননি। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারেননি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশান্তরী হতে হয়েছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। গুম হয়েছেন, জেল খেটেছেন। জামায়াত নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে। জেল খাটতে হয়েছে। দুই দলের জন্যই ১৬টি বছর ছিল বিভীষিকাময়। এত কিছুর পর ছাত্র-জনতার বিপ্লব ও অভ্যুত্থানে সবার মধ্যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় প্রকাশ পায়। জুলাই বিপ্লবপরবর্তী রাজনীতিতে সুবাতাস বইবে, এমন প্রত্যাশাই ছিল দেশবাসীর। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। গত ১৩ এপ্রিল লন্ডনে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সরকারের তিন উপদেষ্টা নাহিদ, আসিফ ও মাহফুজ সেনাকুঞ্জে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এ দুটি ঘটনায় তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। ২৮ ফেব্রুয়ারি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে বিশাল আয়োজন করে বিপ্লবীদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ ঘটে। বিএনপিসহ অন্য সব রাজনৈতিক দলের নেতারা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। সব মহল নতুন দলকে স্বাগত জানায়। এরপর মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও এনসিপির দূরত্ব দিনদিন বাড়তে থাকে। পুরান ঢাকায় সোহাগ হত্যাকাণ্ডের পর এ দূরত্ব আরও বেশি বিস্তৃত হয়। জামায়াত ও এনসিপির নেতারা বিএনপি ও দলনেতা তারেক রহমানের চরিত্রহনন করার মতো অসৌজন্যমূলক মন্তব্য ও বক্তব্য প্রদান করতে থাকেন। অফলাইনের চেয়ে অনলাইনে এটি আরও ভয়াবহ রূপ লাভ করে। এ অবস্থা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এর শেষ কোথায় আপাতত তা বলা যাচ্ছে না। জামায়াতের বিএনপিবিরোধী অপপ্রচারের জবাব হিসেবেই সোমবার আলোচিত স্লোগানটির আবিষ্কার সৃজন এবং ব্যাপক উচ্চারণ।
বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, স্বাধীনতার পক্ষশক্তি-বিপক্ষশক্তি নিয়ে আলোচনা তত দিনই থাকবে। কারণ দেশটি স্বাধীন হতে অনেক রক্ত, অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। এটা একটি ইতিহাস। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগ স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে এও অস্বীকার করার ন্যূনতম উপায় নেই যে জামায়াতে ইসলামী এবং এর সহযোগীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। অবশ্য স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও দলটি এখনো তাদের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা অস্বীকার করে না। এটা অবশ্য তাদের রাজনৈতিক স্বচ্ছতা। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবার নিহত হওয়ার পর ব্যক্তি মুজিবের মৃত্যু হলেও তার দল ছিল, তার আদর্শ ছিল। কিন্তু তার কন্যা শেখ হাসিনা গত ১৬ বছরে পিতার বন্দনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাণিজ্য করেছেন। রাস্তার মোড়ে মোড়ে পিতার মূর্তি তৈরি করেছেন। অফিস-আদালতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বানিয়েছেন মুজিব কর্নার। নিজের পরিবারের সদস্যদের নামে সরকারি টাকায় শত শত প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেছেন। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা বাংলাদেশে শ্রেষ্ঠ স্বৈরাচারে পরিণত হন। তার স্বৈরাচারী আচরণের কারণেই নিজ হাতে পিতার সম্মান ও আওয়ামী লীগকে ৫ আগস্ট হত্যা করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে দিল্লিতে আশ্রয় নিয়েছেন। জুলাই বিপ্লবে তার পিতার স্মৃতি ধুলায় মিশে গেছে। স্বাধীনতা নিয়ে একক বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে গেছে। স্বাধীনতা যেহেতু শেখ পরিবার বা আওয়ামী লীগের একক সম্পত্তি ছিল না, সে কারণেই স্বাধীনতার পক্ষশক্তি বাংলাদেশে সব সময়ই থাকবে। স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বরাবরই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। এখনো আছে। সে কারণেই রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, সোহাগ হত্যাকাণ্ডের পর রাজনীতিতে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে এক অর্থে বিএনপির জন্য ভালোই হয়েছে। আগামী নির্বাচনের আগে বিএনপির সামনে পরিষ্কার হলো কারা তাদের প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য প্রতিপক্ষ। দেরি করে হলেও বিএনপি বুঝতে পারল স্বাধীনতার পক্ষশক্তি আর বিপক্ষশক্তি কখনো সমমনা হয় না। যদিও প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিএনপি জামায়াতকে সমমনা হিসেবেই মনে করেছিল।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন যেমন নতুন করে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে, তেমন অস্বস্তি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে। বাণিজ্য বিশ্লেষক, রাজনৈতিক মহল ও ব্যবসায়ী সমাজ সবাই মনে করছেন, দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে যে টানাপোড়েন চলছে তা শুধু শুল্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সরকারের পক্ষ থেকে যে দরকষাকষি চলছে, তা শুধু বাণিজ্য বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বাণিজ্যের বাইরের অনেক বিষয়েই আটকে আছে সমাধান। আগামী সপ্তাহে তৃতীয় দফায় দরকষাকষির আলোচনা করতে ওয়াশিংটনে যাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল। আলোচনা যতই হোক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্টই (গোপনীয়তার চুক্তি) হলো মূল বিষয়। সরকারের পক্ষ থেকে সে বিষয়ে কেউ কিছু বলছেন না। সোমবার সরকারের উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন সংবাদ সম্মেলন করেছেন। উপদেষ্টার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হয়েছে, তিনি কিছু না বলার জন্যই হয়তো সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে তথ্য লুকানোর প্রবণতা দেখে বাণিজ্য ও ব্যবসায় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা কেবল বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ভূরাজনৈতিক কৌশলগত বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। যার মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশ যাতে চীনের দিকে বেশি ঝুঁকে না পড়ে। বাংলাদেশ যাতে চীনের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য খুব বেশি বাড়াতে না পারে। এমনকি বড় ধরনের চীনা বিনিয়োগও যেন বাংলাদেশে আর না হয়। জানা গেছে, বাণিজ্যের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র এক বা একাধিক ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি চাচ্ছে, যার মধ্যে নিরাপত্তা ইস্যুও থাকবে। এ অঞ্চলে বাণিজ্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক কিংবা অন্যান্য আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো নিশ্চিত করতে চায় ট্রাম্প প্রশাসন। দুই দেশের সম্পর্কের এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগে আমরা কোন শর্তের বেড়াজালে জড়াব, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন