নামেই তালপুকুর, ঘটি ডোবে না। কিংবা ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার। এ দুটি বহুল উচ্চারিত বাংলা প্রবচন যথাযথ ভাবেই প্রযোজ্য হতে পারে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) ক্ষেত্রে। কারণ ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা পৌরসভা, ২০১১ সালের ১০ জুলাই সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়। তারপর কেটে গেছে ১৪ বছর। গোমতী নদীতে জোয়ার-ভাটা এসে গেছে কত শতবার। ৫৩ বর্গকিলোমিটার কুসিক এলাকায় বসবাস করে ১০ লক্ষাধিক মানুষ। প্রতিদিনই জনসংখ্যা বাড়ছে। তবে সিটি করপোরেশনের সেবার সক্ষমতা বাড়ছে না, উল্টো জনবল কমছে। প্রতিষ্ঠার ১৪ বছরেও জনবল কাঠামো অনুমোদন হয়নি। বর্তমানে যে জনবল দেশের যে কোনো তৃতীয় শ্রেণির পৌরসভা থেকেও কম। জনবল সংকটে ধুঁকছে সিটি করপোরেশন। ব্যাহত হচ্ছে নাগরিক সেবা। নগরবাসীর অভিযোগ- কুমিল্লা সিটি করপোরেশন মূলত একটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। এ নিয়ে জাতীয় আঞ্চলিক এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনেক সংবাদ প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। ফলাফল শূন্য।
২০১১ সালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার সময় এর জনবল ছিল ১১৭ জন। মৃত্যু, অবসর ও বদলিতে তা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৬৭ জনে। এদিকে ২০১৩ সালে ১৪৪২ জনবলের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছিল। সেখান থেকে কাটাছেঁড়া করে ২৪২ জনে এসে ঠেকেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হয়ে ২০২৪ সালের ১০ জানুয়ারি তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তারপর আর কোনো অগ্রগতি নেই। আগামী দুই-তিন বছরে অবসরজনিত কারণে আরও বড় সংখ্যক জনবল খালি হয়ে যাবে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠার পর থেকে মাত্র তিনটি জনবল নিয়োগ দিয়েছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন। এ ছাড়া মেয়র নেই, কাউন্সিলর নেই। ৩৬ জন কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালন করছেন কর্মকর্তারা। এতে ওই কর্মকর্তারা তার নিজের দায়িত্বও সঠিকভাবে পালন করতে পারছেন না। জনবল সংকটে সিটি করপোরেশনের সেবার লেজে গোবরে অবস্থা। এদিকে বর্তমান প্রশাসক সাইফ উদ্দিন আহমেদ মূলত কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) মহাপরিচালক। প্রশাসক তার অতিরিক্ত দায়িত্ব। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদ শূন্য এক মাস ধরে। সচিব মোহাম্মদ মামুন, নিজের দায়িত্বের সঙ্গে আবার ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সায়েম ভুইয়া প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, সমন্বিত আবাসন উন্নয়ন প্রকল্প কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন। মো. মোস্তাফিজুর রহমান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, তিনি উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। মোহম্মদ ইউসুফ সহকারী প্রকৌশলী বিদ্যুৎ, তিনি পানি শাখা ও একটি ওয়ার্ডের প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছেন। মেজবাহ উদ্দিন ভুইয়া ফুড অ্যান্ড স্যানিটেশন বিভাগের দায়িত্বে, তার অতিরিক্ত দায়িত্ব জন্ম নিবন্ধন, ভেটেরিনারি শাখা ও একটি ওয়ার্ডের প্রশাসক। ভয়াবহ সংকট বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শাখায়, এ শাখার তিনটি অঞ্চল থাকার কথা। প্রশাসনিক কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ বাজার কর্মকর্তা ও একটি ওয়ার্ডের প্রশাসক। কুসিকের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন বলেন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে যে কোনো পৌরসভা থেকে কম জনবল। বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে। স্বল্প জনবলে প্রত্যাশিত সেবা দেওয়া কঠিন শুধু নয়, প্রায় অসম্ভব। বিশেষ করে বর্জ্য শাখায় ডে-লেবার দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। অস্থায়ী শ্রমিক দিয়ে ভালো কাজ পাওয়া সম্ভব নয়। এদিকে নাগরিকরা মনে করছেন, ১৪ বছরে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের একটি জনবল কাঠামো অনুমোদন না হওয়া স্থানীয় সরকার, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে অবহেলার দুর্ভাগ্যজনক নমুনা। তৃতীয় শ্রেণির পৌরসভার থেকেও কম জনবল দিয়ে একটি সিটি করপোরেশন কীভাবে চলে তা বিস্ময়কর। আসলে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন একটি সাইনবোর্ড ছাড়া কিছু পায়নি। জনবল বৃদ্ধি ও নাগরিক সেবা প্রদানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে সত্যিকার সদিচ্ছা নিয়ে কার্যকর প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী