একাধিক অপরাধে এখন কারাগারে আছেন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও এমপি গোলাম দস্তগীর গাজী। ১৫ বছর ধরে তিনি তার নির্বাচনি এলাকাকে শ্মশানে পরিণত করেছেন। গোটা রূপগঞ্জ রীতিমতো দখল করে নিয়েছেন গাজী এবং তার পরিবার। লুণ্ঠন করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। গাজী গ্রেপ্তার হলেও তার পরিবারের অন্য সদস্যরা এখনো পলাতক। গাজী একা অপরাধী নন, গাজীর পৃষ্ঠপোষকতায় তার পরিবারের সদস্যরাও একেকজন দানবে পরিণত হয়েছিলেন। তারা মাদক ব্যবসা, ভূমি দখলসহ নানান অপরাধে জড়িত হয়েছিলেন। গাজী নিজেই রূপগঞ্জে বলতেন যে তিনি রাজনীতি থেকে অবসরে যাচ্ছেন। তার অবসরের পর পুত্র পাপ্পা গাজী তার নির্বাচনি এলাকা দেখভাল করবেন বলে তিনি ঘোষণা করেছিলেন। পাপ্পা গাজীকে সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন গোলাম দস্তগীর গাজী। পাপ্পা গাজী পিতার চেয়েও বড় দানবে পরিণত হন। গাজীর চেয়েও হিংস্র এবং পৈশাচিক ছিলেন পাপ্পা গাজী। তবে পাপ্পা গাজীর প্রধান কাজ ছিল রূপগঞ্জের মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ।
পাপ্পা গাজীর নেতৃত্বেই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ পরিণত হয় মাদকের অভয়ারণ্যে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রূপগঞ্জে মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন পাপ্পা গাজী। সেখানে গড়ে উঠেছিল তার নিজস্ব বাহিনী। দ্রুত ধনী হওয়ার নেশায় অনেকেই এ কাজে পাপ্পার সহযোগী হয়েছিলেন। পুলিশ কিংবা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ দপ্তরকে হাতে নিয়ে পাপ্পা গড়ে তোলেন মাদক সাম্রাজ্য।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, গোলাম মূর্তজা পাপ্পা গাজী, এমদাদুল হক দাদুল ও মিজানুর রহমান মিজানের হাতেই মূলত রূপগঞ্জের মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ ছিল। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রূপগঞ্জে মাদক কারবার অবাধে চালিয়েছে গত ১৬ বছরে। পাপ্পার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী মাদক কারবারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। মাদক কারবারের বদৌলতে রূপগঞ্জেই কোটিপতি হয়েছেন অন্তত ৩৮ জন। আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনে রূপগঞ্জে মাদক ব্যবসার ভাগাভাগির দ্বন্দ্বে ১৪ জন খুনের ঘটনা ঘটেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রূপগঞ্জে মাদকের এই যে কারবার, এর মূল হোতাই গোলাম দস্তগীর গাজীর ছেলে গোলাম মূর্তজা পাপ্পা, তার দুই সহযোগী ছিলেন এমদাদুল হক দাদুল ও মিজানুর রহমান মিজান। রূপগঞ্জের ফেনসিডিলের একক নিয়ন্ত্রণ ছিল থানা ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজের হাতে। জানা গেছে, রূপগঞ্জেও ৪০০ স্পটের মাদকের টাকা যেত এদের তিনজনের কাছে। প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার ভাগ পেতেন তারা।
রূপগঞ্জ শিল্পএলাকা হওয়ায় ভাসমান শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। এসব শ্রমিককে টার্গেট করে এক শ্রেণির মাদক ব্যবসায়ী শিল্পকারখানার আশপাশে মাদকের ব্যবসা চালিয়ে আসছে। অপরদিকে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ আবাসন কোম্পানি গড়ে ওঠায় এসব এলাকায় জমির ব্যবসাও জমজমাট। জমির ব্যবসার কাঁচা টাকা হাতিয়ে নিতে এক শ্রেণির মাদক কারবারি কারবার চালিয়ে গেছেন গাজীর ছত্রচ্ছায়ায়। স্থানীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে রূপগঞ্জের অনেক কিছুই মাদককে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে গত ১৫ বছর। অভিযোগ রয়েছে, সমাজের এক শ্রেণির লোক অসৎ রাজনীতিবিদ এবং অসাধু পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি কিছু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে এলাকায় মাদক বাণিজ্য করে বেড়াচ্ছে। গড়ে তুলছে টাকার পাহাড়। বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে লোকদেখানো অভিযান চালানো হলেও ভিতরে ভিতরে তারা মিলেমিশে ওই কাজ করছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রূপগঞ্জের কাঞ্চন পৌরসভা, তারাব পৌরসভা, কায়েতপাড়া, দেইলপাড়া, নগরপাড়া, ইছাপুরা, বাগবাড়ী, দাউদপুর, গোলাকান্দাইল, মুড়াপাড়া, ভুলতা ইউনিয়ন মাদকের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। চনপাড়া বস্তি হচ্ছে মাদকের হাট। এখানে সন্ধ্যা হলেই ফেনসিডিল ও ইয়াবা মেলে। দাউদপুর ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রাম, গোবিন্দপুরসহ আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে চোলাই মদের কারখানা।
সরেজমিন তদন্তে দেখা যায়, উপজেলায় প্রায় ৭০ হাজার মাদকসেবী রয়েছে। বছরে এসব মাদকসেবী মাদকের জন্য খরচ করে শত কোটি টাকা। মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে প্রায় ৫০০। আর খুচরা ব্যবসায়ীও প্রায় ১ হাজার। এসব মাদকের ছোবলে হাজার হাজার তরুণের জীবন প্রায় বিপন্ন। মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত চুনোপুঁটিরা ধরা পড়লেও রাঘববোয়ালরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। এরা সবাই ছিল পাপ্পা গাজীর ছত্রছায়ায়।
রূপগঞ্জে সড়ক ও নৌপথে অবাধে মাদকদ্রব্য আসতো। এই নেটওয়ার্ক পরিচালিত হতো গাজীর তত্ত্বাবধানে। মাদক প্রবেশের সবচেয়ে নিরাপদ রুট ছিল বালু নদ। এ নদে পুলিশ টহলের ব্যবস্থা না থাকায় মাদক কারবারিরা নির্বিঘ্নে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারযোগে মাদক আনা-নেওয়া করেন। এ ছাড়া শীতলক্ষ্যা নদ দিয়েও মাদকদ্রব্য রূপগঞ্জে ঢোকে। এ নদ দিয়ে পণ্যবাহী জাহাজে করে মাদক ঢোকে রূপগঞ্জে। এদিকে কুমিল্লা থেকে এশিয়ান হাইওয়ে সড়ক দিয়ে বিভিন্ন যানবাহনে মাদক ঢোকে রূপগঞ্জে। আশুগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে মাদক ঢোকে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভুলতা হচ্ছে মাদকের ট্রানজিট পয়েন্ট। আখাউড়া, সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফেনসিডিল, ইয়াবা ও হেরোইন বাস, নাইট কোচ, সংবাদপত্রবহনকারী মোটরসাইকেল কিংবা ট্রাকযোগে ওই এলাকায় আসত নিয়মিত। আর এসব মাদক কেনাচোর নিয়ন্ত্রণ ছিল পাপ্পার হাতে।
নানা কৌশলে মাদক বহন করা হতো। ইয়াবা ও ফেনসিডিল বহন করা হয় লাউ, নারিকেল আর ম্যাচের বাক্সের ভিতরে করে। হেরোইন বহন করা হয় মিষ্টির প্যাকেটের ভিতরে করে। আর গাঁজা বহন করা হয় চটের ব্যাগের ভিতরে করে। মাদক বহনের কাজে ব্যবহার করা হয় কোমলমতি ছেলে-মেয়েদের। সূত্রটি জানায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মহিলাদের দিয়ে মাদক বহন করা হয়। মহিলাদের স্পর্শকাতর জায়গায় ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন ও গাঁজা রেখে বহন করা হয়। মাদক কারবারির সুবিধার্থে রূপগঞ্জে ৭০০-এর বেশি শিশু-কিশোর সেলসম্যান তৈরি করেছিলেন পাপ্পা গাজী। মাদকের এ গডফাদার টাকা পয়সার ঝামেলা হলেই নৃশংস ভাবে হত্যা করতো।
২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট মাদকের টাকা দিতে অস্বীকার করায় গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের মাহনা এলাকায় ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম মোল্লাকে তার নেশাগ্রস্ত ছেলে মিলন মোল্লা ও তার সহযোগীরা হত্যা করে। ২০১৪ সালে চনপাড়া বস্তিতে মাদক কারবারে বাধা দেওয়ায় মিয়া নামে একজনকে খুন করে পিচ্চি মালেক। ২০১৫ সালের ২৫ অক্টোবর চনপাড়া বস্তিতে মাদক কারবারে বাধা দেওয়ায় আবদুর রহমান নামের এক যুবককে প্রকাশ্য দিবালোকে রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে মাদক তারা। ২০২১ সালে মাদক কারবারে বাধা দেওয়ায় মাছিমপুর এলাকায় নজরুল ইসলাম বাবু নামে এক যুবককে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে মাদক ব্যবসায়ীরা। ২০১৮ সালে হাটাবো এলাকায় মাদক ব্যবসায় বাধা দেওয়ায় সোহেল মিয়া নামে এক যুবককে হত্যা করে মাদক ব্যবসায়ীরা। ২০১৬ সালের ২৯ মার্চ মাদক সেবনে বাধা দেওয়ায় জনতা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মেহেদী হাসান বাবুকে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২০২০ সালের ৬ মে চনপাড়ায় মাদক ব্যবসায়ী আনোয়ারকে হত্যা করা হয়। ২০২০ সালের ৩১ মে রূপসী কাজীপাড়া এলাকায় রাজনকে হত্যা করা হয়। ২০২২ সালের চনপাড়া পুনর্বাসনের খোরশেদ আলমকে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর মুড়াপাড়া এলাকায় দ্বীন ইসলামকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ৫ শতাধিক। মাদক সেবন করে গত কয়েক বছরে মারা গেছে পাঁচজন।
পাপ্পা গাজীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ১৫ মাদকসম্রাজ্ঞী রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় মাদক জগৎ দাপিয়ে বেরিয়েছে গত ১৬ বছর। এদের কেউ ড্রাগ কুইন, ফেন্সি কুইন, মাদকসম্রাজ্ঞী, কালনাগিনী নামে পরিচিতি লাভ করেছে। আবার কারও বা নাম ডেঞ্জার লেডি। এরাও এলাকায় মাদক ছড়িয়ে দিয়ে তরুণ সমাজকে ক্ষতির মুখে নিয়ে যাচ্ছে। এরা মাদকের পাশাপাশি অসামাজিক কার্যকলাপেরও বিস্তার ঘটিয়েছে।
মাদক কারবার ছাড়াও পাপ্পা গাজী তদবির বাণিজ্য করতেন। নিয়োগ বাণিজ্য করে এলাকার লোকজনের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যখন সরকারি নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হতো, তখনই পাপ্পা গাজী চাকরি প্রার্থীদের তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলতেন। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে পাপ্পা ১২৩ জনের কাছ থেকে জনপ্রতি ৫ লাখ টাকা নেন। পরীক্ষার ফলাফলের পর দেখা যায়, চাকরি পেয়েছেন মাত্র তিনজন। বাকিদের টাকা ফেরত দেননি পাপ্পা।
এসআই নিয়োগে পাপ্পা স্থানীয় প্রায় ২০০ জনের কাছে ১০ লাখ টাকা করে নেন। এদের মধ্যে মাত্র পাঁচজনের চাকরি হয়। বাকিদের চাকরি না হলেও টাকা ফেরত দেননি। এভাবে বিভিন্ন নিয়োগের কথা বলে টাকা নিয়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন পাপ্পা। এ ছাড়াও বদলি বাণিজ্য এবং টেন্ডার বাণিজ্যের অভিযোগও আছে গাজীপুত্রের বিরুদ্ধে।
পাপ্পা গাজী এখন পলাতক। একাধিক সূত্র বলছে, তিনি এখন বিদেশে অবস্থান করছেন। বিদেশে বসেই মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণ করছেন এ দুর্বৃত্ত।