পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যায় কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই। এর নেপথ্যে ছিল পল্লী বিদ্যুতের চোরাই তারের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ। হত্যায় জড়িতরা ও ভিকটিম সোহাগ ছিলেন পূর্বপরিচিত। হাজি সেলিমের ভাগনের ছত্রছায়ায় চোরাই তারের ব্যবসা করতেন সোহাগ। গত বছর ৫ আগস্টের পর স্বার্থগত দ্বন্দ্বের জেরেই এ হত্যাকাণ্ড হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। গতকাল ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সোহাগ হত্যার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে জানাতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এদিকে সোহাগ হত্যা মামলায় আরও তিন আসামির সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির কমিশনার বলেন, ঘটনাটি জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর মাধ্যমে চকবাজার থানার ওসি সংবাদ পাওয়ার কিছু সময়ের মধ্যে চকবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই সরোয়ার ঘটনাস্থলে পৌঁছান। সেখানে গিয়ে দেখেন অভিযুক্তরা মবের পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছেন। হত্যাকাণ্ডের সময় ‘চাঁদাবাজদের জায়গা নাই, ব্যবসায়ীদের ভয় নাই’ এমন স্লোগান দিচ্ছিলেন অভিযুক্তরা। ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থল থেকে সন্দেহভাজন মাহমুদুল হাসান মহিন ও ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে তারেক রহমান রবিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আরও সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাথর নিক্ষেপকারী দুজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে সোহাগকে একাধিকবার কংক্রিটের বোল্ডার দিয়ে আঘাত করা মো. রিজওয়ান উদ্দিন অভিকে মঙ্গলবার পটুয়াখালী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আসামিদের রাজনৈতিক পরিচয় আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি প্রধান বলেন, দেশের যে কোনো নাগরিকের রাজনৈতিক পরিচয় থাকতেই পারে। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। এ ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। হত্যার নেপথ্যের কারণ সম্পর্কে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, সোহাগ বিগত সরকারের সময় সাবেক এমপি হাজী সেলিমের ভাগনে কাউন্সিলর মো. হাসান পিল্লুর ছত্রছায়ায় পল্লী বিদ্যুতের চোরাই তারের ব্যবসা করতেন। চোরাই তার কিনে অ্যালুমিনিয়ামের কারখানায় বিক্রি করা হতো। ১৭ বছর ধরে সোহাগ এ কাজ করেছেন। ৫ আগস্টের পর ভোল পাল্টে অন্য রাজনৈতিক দলে ভিড়েন। ইতোমধ্যে আরেকটি গ্রুপ এ ব্যবসায় জড়িয়ে যায়। তখন ব্যবসায়িক বিভেদ তৈরি হয় তাদের মধ্যে। তারা উভয় পক্ষই পূর্বপরিচিত। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ও কোন্দল থেকে এ হত্যাকাণ্ড বলে জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা।
এ হত্যার পেছনে রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য ছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্ব থেকে হত্যাকাণ্ডটি হয়েছে। নির্বাচনকে প্রভাবিত করা বা সরকারকে বেকায়দায় ফেলানো বা অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড হয়নি। মামলার এজাহার নিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, এ ঘটনার মামলার এজাহার দায়েরের জন্য প্রথমে সোহাগের প্রথম স্ত্রী লাকী আক্তার থানায় আসেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সোহাগের সৎভাই রনিও আসেন। তারা নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে ২৩ জনকে আসামি করে খসড়া এজাহার প্রস্তুত করেন। এর মধ্যে ভুক্তভোগীর আপন বড় বোন মঞ্জুয়ারা বেগম থানায় এসে এজাহার দাখিলের আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন তার সামনে আগের খসড়া এজাহার উপস্থাপন করা হয়। তখন বাদীর মেয়ে ওই খসড়া এজাহারের ছবি তুলে রাখে। পরে সেই এজাহার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভুক্তভোগীর বোন ওই খসড়া এজাহার থেকে পাঁচজনের নাম বাদ দিয়ে নতুনভাবে আরও একজনের নাম সংযোজন করেন। পরে মোট ১৯ জনকে আসামি করে এজাহার দাখিল করেন। এদিকে সোহাগকে হত্যা মামলায় আরও তিন আসামির সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম মো. সাইফুজ্জামান আদেশ দেন। রিমান্ডের আসামিরা হলেন- তারেক রহমান রবিন, মো. নান্নু কাজী ও মো. রিজওয়ান উদ্দিন অভি ওরফে অভিজিৎ বসু। আসামিদের মধ্যে রবিন অস্ত্র মামলায় এর আগে দোষ স্বীকার করেছেন। বাকি দুজন নতুন। এর আগে এ মামলায় গত ১২ জুলাই টিটন গাজীর পাঁচ দিন, ১৩ জুলাই মো. আলমগীর ও মনির ওরফে লম্বা মনিরের চার দিন, ১৪ জুলাই রাজিব বেপারী ও সজিব বেপারীর ৫ দিন ও মাহমুদুল হাসান মহিনের দ্বিতীয় দফায় ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এ ছাড়া এ ঘটনায় করা অস্ত্র আইনের মামলায় তারেক রহমান রবিন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, গত ৯ জুলাই পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনের ব্যস্ত সড়কে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগকে হত্যা করা হয়। তাকে পিটিয়ে, কুপিয়ে, ইট ও পাথর দিয়ে আঘাত করে মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে দেয় অভিযুক্তরা। একপর্যায়ে তাকে বিবস্ত্র করে শরীরের ওপর উঠে নাচানাচি করেন কেউ কেউ। এরপর মব নাটক সাজানোর চেষ্টা করা হয়। ১০ জুলাই নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের বোন মঞ্জুয়ারা বেগম বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। মামলায় ১৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ১৫-২০ জনকে আসামি করা হয়। নির্মমতার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চেয়ে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে কিলিং মিশনের কেউ কেউ পুঞ্জীভূত ক্ষোভে হামলে পড়েছিল সোহাগের ওপর। যারা বিভিন্ন কারণে অতীতে সোহাগের কাছে নির্যাতনের শিকার অথবা ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছিল। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত সোহাগের ওপর পাথর নিক্ষেপকারী মো. রিজওয়ান উদ্দিন অভিসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন- আলমগীর, মনির ওরফে লম্বা মনির, মো. টিটন গাজী, মাহমুদুল হাসান মহিন, তারেক রহমান রবিন, নান্নু গাজী, সজিব বেপারী ও রাজিব বেপারী। সর্বশেষ গ্রেপ্তার অভি পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, ২০১৮ সালে সোহাগ তার ফুটপাতের দোকানটি দখল করে এবং মোবাইল ফোনটি কেড়ে নেয়। এ মোবাইলে তার (অভি) স্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও ছিল। এ বিষয়ে থানায় জিডিও করে অভি। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে ওই মোবাইল ফোনটি ফেরত পান অভি। কিন্তু মোবাইলে ফোনে থাকা ভিডিও দিয়ে তার সঙ্গে প্রতারণা করে সোহাগ। জিম্মি করে ৯০ হাজার টাকাও নেন। এরপর তিনি বিদেশ চলে গেলে ওই ভিডিও ও ছবি দিয়ে তার স্ত্রীকেও জিম্মি করা হয়। এটি সহ্য করতে না পেরে এক পর্যায়ের তার স্ত্রী আত্মহত্যা করেন বলেও জানিয়েছেন অভি।