সাগরকন্যা সিঙ্গাপুর। দক্ষিণ চীন সাগর ও ভারত মহাসাগরের সংযোগস্থল মালয় উপদ্বীপের দক্ষিণাংশে সিঙ্গাপুরের অবস্থান। অর্ধশতের অধিক ক্ষুদ্র দ্বীপ এবং একটি বৃহৎ দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দ্বীপদেশ। বৃহৎ দ্বীপটির নাম সিঙ্গাপুর। এটির নামেই দেশটির নামকরণ হয়েছে। দেশটির আনুষ্ঠানিক নাম সিঙ্গাপুর প্রজাতন্ত্র। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটি একটি শহর-রাষ্ট্র। সিঙ্গাপুরের আয়তন ৫৭২ বর্গকিলোমিটার।
বাকি দ্বীপগুলোর সমন্বিত আয়তন মাত্র ৪৬ বর্গকিলোমিটার। ছোট দ্বীপগুলোর অর্ধেকই জনবসতি শূন্য। সিঙ্গাপুরের বর্তমান জনসংখ্যা ২৭ লাখ। ২০২০ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দেশটিতে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ১৫.৬ শতাংশ।
ইসলাম সেখানে তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম। মুসলমানরা প্রধানত সুন্নি মুসলমান, যারা হানাফি বা শাফেঈ মাজহাবের অনুসারী। মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ জাতিগতভাবে মালয়। ১৩ শতাংশ ভারতীয় এবং বাকিরা চীনা, ইউরোপীয় ও আরব। শিল্পসমৃদ্ধ সিঙ্গাপুরের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মুসলমানদের ইতিহাস।
অগণিত বাঘের এ দ্বীপটির নামকরণ হয় সিঙ্গাপুর অর্থাৎ সিংহের শহর বলে। সাংস্কৃতিক ভাষায় সিঙ্গাপুর শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১১ থেকে ১৮ শতাব্দী পর্যন্ত সিঙ্গাপুর ছিল জলদস্যু ও মৎস্য শিকারিদের স্থান। ১২ থেকে ১৩ শতাব্দী পর্যন্ত সিঙ্গাপুর পোতাশ্রয়ের নাম ছিল টুমাসিক। তখন এটি ছিল পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র। ১৩৩৭ সালে জাভার আক্রমণকারীরা টুমাসিক দখল করে নেয়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির এজেন্ট স্যার স্টমফোর্ড রাফেলস সিঙ্গাপুরের বাণিজ্যিক গুরুত্বর কথা অনুধাবন করে ১৪১৯ সালে জহরের সুলতানের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন (জহর তখন সিঙ্গাপুরের সঙ্গে একীভূত ছিল, যা বর্তমানে মালয়েশিয়ার অংশ)। বাণিজ্যের নামে ইংরেজরা দ্বীপটির শাসনক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালাতে থাকে। ১৮২৪ সালে সমগ্র সিঙ্গাপুর ব্রিটিশদের দখলে চলে যায়। মাত্র দুই বছর পর ১৮২৬ সালে দখলকৃত এ দ্বীপটিকে ইংরেজরা ব্রিটিশ কলোনির অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। এর পর থেকে সিঙ্গাপুরের উন্নতি শুরু হয়।
১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সুিপ্রম কোর্ট সিঙ্গাপুরের সর্ববৃহৎ আদালত। এ ছাড়া আছে জেলা আদালত, ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং বিশেষ আদালত। প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং অন্য বিচারপতিদের নিয়োগ করেন। সামরিক দিক থেকে দেশটি বেশ উন্নত।
সিঙ্গাপুরের অধিবাসীদের বেশির ভাগই চীনা বংশোদ্ভূত। মালয় বংশোদ্ভূত মুসলমানরা সংখ্যালঘুদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ। চীনা বংশোদ্ভূতরা জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ, মুসলমানরা প্রায় ১৭ শতাংশ। অন্যরা ইউরোপ ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের প্রায় সবাই হিন্দু। ইউরোপীয়রা খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী। সংখ্যাগরিষ্ঠ চীনারা বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী। তবে দেশটিতে কোনো রাষ্ট্রীয় ধর্ম নেই।
প্রায় চার লাখ মুসলমানের জন্য সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন স্থানে ৮৩টি মসজিদ গড়ে উঠেছে। মসজিদগুলোর মধ্যে ৭৬টি নির্মিত হয়েছে গত শতাব্দীতে। অন্যগুলোর নির্মাণকাজ শেষে হয়েছে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে। সরকারি অনুমোদন নিয়ে সিঙ্গাপুরের ইসলামিক কাউন্সিল সামাজিক নিরাপত্তা বিভাগের সহায়তায় আরো ছয়টি মসজিদ নির্মাণের জন্য প্লট ক্রয় করেছে। নির্মিতব্য মসজিদগুলোতে দেড় থেকে দুই হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবে। এ ছাড়া এগুলোতে ইসলামী শিক্ষালাভ এবং পবিত্র কোরআন হিফজ করার ব্যবস্থা আছে। মসজিদগুলো এমইউআইএস সংগঠন দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। মসজিদ ছাড়াও ইসলাম শিক্ষার জন্য সিঙ্গাপুরে ছয়টি পূর্ণাঙ্গ মাদরাসা রয়েছে। সিঙ্গাপুর সরকার সব সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। সব ধর্মাবলম্বীই তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নে পালন করতে পারে। ধর্মের নৈতিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে সিঙ্গাপুর সরকার ১৯৮০ সাল থেকে পাঠ্য বইয়ে ধর্মীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছে। ১৯৮৩ সাল থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
সিঙ্গাপুরে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বিভিন্ন সংগঠন ও কাউন্সিল কাজ করছে। সরকারি অনুমোদনক্রমে মুসলিমদের তত্ত্বাবধান এবং মসজিদ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে ‘সিঙ্গাপুর ইসলামিক কাউন্সিল’ গঠন করা হয়েছে। এই কাউন্সিল মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রশাসন ও স্বার্থ দেখাশোনা করে। ১৮৮০ সালে সরকার ‘মোহামেডান ম্যারেজ অর্ডিন্যান্স’ প্রবর্তন করে। ১৯৫৮ সালে মুসলিম বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদের মামলাসংক্রান্ত বিরোধ শোনা এবং মীমাংসার জন্য একটি শরয়ি আদালত গঠন করা হয়। দ্বীপদেশটিতে মালয় মুসলিম সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক কর্মক্ষমতা উন্নত করার জন্য ১৯৯১ সালে ‘অ্যাসোসিয়েশান অব মুসলিম প্রফেশনালস’ গঠিত হয়েছে। এ ছাড়া মুসলমানদের স্বার্থ ও নানা বিষয় দেখভাল করার জন্য বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন ও কল্যাণ সংস্থা আছে সিঙ্গাপুরে। ফলে দেশটিতে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে মুসলিম জনসংখ্যা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক ও সাবেক ডিএমডি, আইবিবিএল এবং এএমডি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক