পবিত্র কোরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা জানতে তার ভাষারীতি সম্পর্কে অবগত হওয়া আবশ্যক। কেননা শব্দ, বাক্য ও পরিভাষা ব্যবহারে কোরআনের নিজস্ব রীতি রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) থেকে পরবর্তী কোরআন গবেষক অনেকেই কোরআনের ভাষারীতি আলোচনা করেছেন। যেমন—আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, কোরআনে বর্ণিত প্রত্যেক ‘কাসুন’ (পাত্র) শব্দ দ্বারা মদ উদ্দেশ্য। (ফাহমুল কোরআন, পৃষ্ঠা ৫৩)
কোরআনের কয়েকটি ভাষারীতি
তাফসিরবিদ আলেমরা এ বিষয়ে একমত যে পবিত্র কোরআনের নিজস্ব ভাষারীতি রয়েছে। তাঁরা এ ক্ষেত্রে একাধিক দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। যেমন—
১. সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ কোরআনে ‘মাতারুন’ (বৃষ্টি) শব্দটি শাস্তির অর্থে ব্যবহার করেছেন। আর বৃষ্টি বোঝাতে ‘গাইসুন’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। (ফাতহুল বারি : ৮/১৬৪)
২. ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, কোরআনে ব্যবহৃত ‘ইয়া আইহুহান্নাস’ দ্বারা মক্কার মুশরিকরা উদ্দেশ্য। (দিরাসাতুন আনিল কোরআন, পৃষ্ঠা ১৬১)
৩. আল্লামা জামাখশারি (রহ.) বলেন, কোরআনের রীতি হলো যেখানে হুঁশিয়ারি এসেছে সেখানেই পুরস্কারের অঙ্গীকার এসেছে এবং যেখানে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে সেখানে প্রীতিও প্রদর্শন করা হয়েছে। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৬২)
৪. কোরআনের সাধারণ রীতি হলো যখন কোনো বিষয়ে সংবাদ দেওয়া হয় তখন অতীত বাচক শব্দ ব্যবহার করা হয়। এমনকি ভবিষ্যতের সংবাদ প্রদানেরও সময়ও অতীত বাচক শব্দ ব্যবহার করা হয় নিশ্চয়তার অর্থ প্রদান করতে। (তাফসিরে কাশশাফ : ৫/২১১)
আল্লামা ইবনে আশুর (রহ.) তাঁর তাফসির গ্রন্থ ‘আত-তাহরির ওয়াত-তানভির’-এর ভূমিকায় কোরআনের ভাষারীতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। যার মধ্য থেকে কয়েকটি তুলে ধরা হলো—
৫. কোরআনের ব্যবহৃত ‘হা-উলা’ (এসব লোক) শব্দের পর যদি ব্যাখ্যামূলক কোনো বক্তব্য না থাকে, তবে এর দ্বারা মক্কার মুশরিকরা উদ্দেশ্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বরং আমিই দিয়েছিলাম তাদের ও তাদের পূর্বপুরুষদের ভোগের সামগ্রী।’ (সুরা : জুখরুফ, আয়াত : ২৯)
৬. কোরআনে যখন কোনো কথোপকথন বা প্রশ্নের উত্তর সাধারণভাবে দেওয়া হয় তখন শুধু ‘ক্বলা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। আর যখন কথোপকথনের বিষয়বস্তু পরিবর্তন করা হয়, তখন ‘ক্বলা’ শব্দের শুরুতে ‘ওয়াউ’ বর্ণ যোগ করা হয়। সুরা বাকারার ২৯ থেকে ৩৩ নং আয়াতে এমনটি করা হয়েছে।
৭. কোরআনের একটি রীতি হলো, যখন অবিশ্বাসীদের কোনো কাজের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় তখন মুসলমানদেরও সতর্ক করা হয়। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘কোরআনের যেখানেই অবিশ্বাসীদের অবস্থার নিন্দা করা হয়েছে, তার দ্বারা মুসলিমদের সতর্ক করা উদ্দেশ্য।’ মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা পুনরায় আরম্ভ করবে তারাই অগ্নি-অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৫)
৮. কোরআন উদ্দেশ্যহীন ও অপ্রয়োজনীয় শব্দ-বাক্য ব্যবহার করে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যখন ইবরাহিম বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক! এটাকে নিরাপদ শহর কোরো’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১২৬)
উল্লিখিত আয়াতে ইঙ্গিতবাচক ‘এটা’ উল্লেখ করায় মক্কা নগরীর নাম বা তার প্রতি ইঙ্গিতকারী অন্য শব্দ পরিহার করা হয়েছে।
৯. কোরআনের বহু আয়াতে মহানবী (সা.)-কে সম্বোধন করে উম্মতকে সতর্ক করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সত্য তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রেরিত। সুতরাং তুমি সন্দিহানদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৪৭)
১০. কোরআনে একটি অবস্থা বর্ণনার পর ভিন্ন অবস্থার আলোচনাও নিয়ে আসা হয়। যেন বান্দার মনে আশা বা হতাশার জন্ম না হয়। যেমন—দুটি কবিরা গুনাহ উল্লেখ করার পর বলছেন, ‘তোমাদের যা নিষেধ করা হয়েছে তার মধ্যে যা গুরুতর তা থেকে বিরত থাকলে তোমাদের লঘুতর পাপগুলো মোচন করব এবং তোমাদের সম্মানজনক স্থানে দাখিল করব।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৩১)
১১. কোরআনের রীতি হলো বান্দাকে উদ্দেশ্য অর্জনের একাধিক পথ ও পদ্ধতি ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! আল্লাহকে ভয় করো, তাঁর নৈকট্য লাভের উপায় অন্বেষণ করো এবং তাঁর পথে সংগ্রাম করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৩৫)
আয়াতে আল্লাহ সাফল্য লাভের তিনটি উপায় বর্ণনা করা হয়েছে।
১২. শরিয়তের বিধান বর্ণনা করার ক্ষেত্রে কোরআন বিস্তারিত বিবরণের পরিবর্তে মৌলিক বর্ণনাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘পুরুষ চোর ও নারী চোর, তাদের উভয়ের হাত কেটে দাও।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৩৮)
আয়াতে হাত কাটার পদ্ধতি বর্ণনা না করে শুধু কাটার বিধান বর্ণনা করা হয়েছে।
১৩. পূর্ববর্তী নবী-রাসুল ও জাতিগুলোর ঘটনা বর্ণনার ক্ষেত্রে আল্লাহ ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। কোরআনে প্রতিটি ঘটনার ততটুকুই বর্ণনা করেছে যতটুকু মানুষের জন্য প্রয়োজনীয়। আর তা সেভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে, যার দ্বারা উদ্দেশ্য অর্জন হবে।
১৪. কোরআনে কোনো আদেশ দিলে তারপর এই আদেশ পালনকারীদের পুরস্কার এবং তা প্রত্যাখ্যানকারীদের শাস্তিও বর্ণনা করে। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের প্রতি অনুগত হবে ও সৎকাজ করবে তাকে আমি পুরস্কার দিব দুবার এবং তার জন্য আমি প্রস্তুত রেখেছি সম্মানজনক জীবিকা।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৩১)
১৫. কোরআনে যখন একসঙ্গে পূর্ববর্তী একাধিক জাতির ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, সেখানে তাদের অস্তিত্বের ধারাক্রম অনুসারে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমনাা-সুরা আশ-শুআরাতে ধারাবাহিকভাবে ইবরাহিম, নুহ, হুদ, সালিহ, লুত ও শোআইব (আ.)-এর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে কোরআন বোঝার তাওফিক দিন। আমিন।