নগরজীবনের কোলাহল, যানজট, আর ইট-কাঠের দালানচাপা ব্যস্ততা, তার মাঝেও ঢাকার আকাশে ভেসে আসে পাঁচবার আজানের ধ্বনি। এই শহরে সূর্য ওঠে মসজিদের মিনার ছুঁয়ে, আর রাত নামে মসজিদের ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে। ঢাকাকে বলা হয় মসজিদের শহর, কিন্তু এটি কখনো খেলাফতের রাজধানী ছিল না বা খেলাফতের পূর্ণ-প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণেও ছিল না, তবু কিভাবে গড়ে উঠল এই ‘মসজিদের শহর’ সেটি একটি বিস্ময়।
মূলত বাংলায় মসজিদ প্রতিষ্ঠার ধারা বেগবান হয় দুভাবে।
প্রথমত, রাজনৈতিক ইসলামায়নের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত সুফি দরবেশদের দাওয়াতি প্রচেষ্টায়।
ইসলাম বাংলায় আসে যদিও আরব বণিক ও সুফি দরবেশদের মাধ্যমে, তবে ঢাকায় স্থায়ী মুসলিম বসতি ও প্রশাসনিক গুরুত্ব শুরু হয় ১৩০০ সালের পর থেকে। তখন এটি ছিল একটি নগণ্য নদীবন্দর।
ঢাকা প্রকৃতপক্ষে নগরী হিসেবে বিকশিত হয় ১৬১০ সালে, যখন মোগল সুবাদার ইসলাম খান চিশতি এটিকে বাংলার রাজধানী ঘোষণা করেন। ইসলাম খান ঢাকাকে রাজধানী করার পরই শুরু হয় দুর্গ, বাজার, সরাইখানা ও মসজিদ নির্মাণ। তখন ইসলামিক আইন ও শাসনের অংশ হিসেবে প্রশাসনিক কেন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হতো। ইতিহাসবিদ আবদুল করিম তাঁর ‘ডাক্কা : দ্যা মুঘল ক্যাপিটাল’ গ্রন্থে লিখেছেন, ইসলাম খান ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণা করার পর অন্তত ৩৬টি মসজিদ নির্মিত হয়, যার অনেকগুলোর অস্তিত্ব আজও রয়েছে।
অর্থাৎ ঢাকা তথা বাংলা যদিও কখনো মূল খেলাফতে (খুলাফায়ে রাশিদিন, উমাইয়া, আব্বাসীয়া বা উসমানিয়া) সরাসরি যুক্ত ছিল না। তবে এটি স্বাধীন বা আধা-স্বাধীন মুসলিম শাসকদের অধীনে ছিল বহু শতাব্দী ধরে এবং এর ইসলামী রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বিচারব্যবস্থা ছিল দৃঢ়, যা মসজিদনির্ভর সমাজ গঠনে সহায়ক হয়।
দ্বিতীয়ত, মসজিদ নির্মাণের এই ধারায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সুফি ও ওলি-দরবেশদের দাওয়াতি প্রভাব। খানজাহান আলী (রহ.), হজরত শাহজালাল (রহ.) প্রমুখ ব্যক্তিত্ব ধর্মপ্রচারের অংশ হিসেবে যেখানে গিয়েছেন, সেখানেই মসজিদ নির্মাণ করেছেন। ইসলাম প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে তাঁরা মসজিদকে বেছে নিয়েছেন ইবাদতের পাশাপাশি শিক্ষা, আশ্রয় ও চিকিৎসার স্থান হিসেবে।
টি ডব্লিউ আর্নল্ড তাঁর বিখ্যাত বই ‘দ্যা প্রিসিং অব ইসলাম’-এ এই দিকটি বিশেষভাবে উল্লেখ করে বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় সুফিরা ইসলাম প্রচারের জন্য যে কাঠামো তৈরি করেছিল, তার মূলে ছিল মসজিদভিত্তিক নেটওয়ার্ক।’ ঢাকায়ও এই সুফি সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট।
অতঃপর মসজিদ নির্মাণের এই সিলসিলা চলতে থাকে। ইতিহাসের নানা বাঁকবদলে তা থেমে যায়নি, এমনকি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন আমলেও মসজিদ নির্মাণ থেমে যায়নি, বরং মুসলমানদের আত্মপরিচয় ও ধর্মীয় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রতিরোধ দুর্গ হিসেবে মসজিদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তখনকার সময়ে মুসলিম জমিদার, বণিক ও সমাজপতিরা নিজেদের অর্থে বহু মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। চকবাজার শাহি মসজিদ, স্টার মসজিদ এর ঐতিহাসিক উদাহরণ। ইতিহাসবিদ রিচার্ড ইটন ‘দ্যা রাইস অব ইসলাম অ্যান্ড ব্যাঙ্গল ফ্রন্টেয়ার’ গ্রন্থে মন্তব্য করেন, ‘বাংলায় ইসলামের বিকাশের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও স্বউদ্যোগে মসজিদ নির্মাণ।’
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে পূর্ববাংলা পাকিস্তানের অংশ হলে ঢাকায় মসজিদ নির্মাণ এক নতুন মাত্রা পায়। পাকিস্তান রাষ্ট্র নিজেকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করায় অফিস, বিদ্যালয়, বাজার এমনকি সরকারি ভবনেও মসজিদ থাকা একধরনের রীতিতে পরিণত হয়। ১৯৬৮ সালে নির্মিত বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এই সময়ের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ নিদর্শন।
অতঃপর ১৯৭১-এর পর স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকার মসজিদ সংস্কৃতি আরো বিস্তৃত হয়। শহরের দ্রুত নগরায়ণ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি আবাসিক এলাকায় মসজিদ গড়ে ওঠে। কেউ নতুন পাড়া শুরু করলে প্রথমেই ছোট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। ব্যবসায়ী, প্রবাসী, রাজনীতিবিদ ও ধর্মানুরাগীরা প্রতিযোগিতা করে মসজিদ নির্মাণে দান করেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঢাকা শহরেই প্রায় ছয় হাজার মসজিদ রয়েছে এবং এই সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। মোহাম্মদ মজলুম খান তাঁর ‘দ্যা মুসলিম হ্যারিটেজ অব ব্যাঙ্গল’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাণবন্ত ইসলামী নগর, যেখানে প্রতিটি গলির মোড়ে আজান শোনা যায়।’
এভাবেই ঢাকায় সরাসরি রাজনৈতিক খেলাফতের শাসন না থাকলেও ইসলামী শাসনের ছায়া, জনগণের ধর্মানুরাগ, সুফি দাওয়াতি প্রভাব, রাজনৈতিক ইসলামের সাংস্কৃতিক ছাপ, সামাজিক-ধর্মীয় সংগঠনের ভূমিকায় এ শহরে তৈরি হয়েছে হাজার হাজার মসজিদ।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন