আমানত হলো ঈমানের পূর্ণতা ও ইসলামের সৌন্দর্য। আমানতের মাধ্যমে মানুষের জাগতিক সম্পদ, জান-মাল, ইজ্জত ও সম্মান রক্ষা পায়। ইনসাফ তথা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়, প্রকৃত হকদার তার হক ফেরত পায় এবং ন্যায্য পদ থেকে যোগ্য ও বিজ্ঞ ব্যক্তি বঞ্চিত হয় না। ফলে এর মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে স্থিতিশীলতা বিরাজ করে এবং সর্বস্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
‘আমানত’ আরবি শব্দ। এর অর্থ বিশ্বস্ততা, আস্থা, নিরাপত্তা ইত্যাদি। আমানত শব্দটি খিয়ানত বা বিশ্বাসঘাতকতার বিপরীত।
পরিভাষায়, আমানত হলো প্রত্যেক ওই জিনিস, যা বান্দার ওপর অপরিহার্য করা হয়েছে।
যেমন—সালাত, সিয়াম, জাকাত ও ঋণ পরিশোধ করা।
কেউ কেউ বলেন, ‘আমানত হলো এমন সম্পদ, নিষিদ্ধ বিষয় ও গোপন কথা, যা কারো গচ্ছিত ও রক্ষিত থাকে।’
(কিতাবুল কুল্লিয়াত, পৃষ্ঠা-১৭৬)
আমানত আল্লাহর আরশ থেকে বান্দার প্রতি আরোপিত দায়িত্ব : মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমরা তো আসমান, জমিন ও পর্বতমালার প্রতি এই আমানত অর্পণ করেছিলাম, তারা এটা বহন করতে অস্বীকার করল এবং তাতে শঙ্কিত হলো। কিন্তু মানুষ ওটা বহন করল।
সে তো অতিশয় জালিম, অতি অজ্ঞ।’
(সুরা : আহজাব, আয়াত : ৭২)
আরোপিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা গুরুত্বপূর্ণ আমানত
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জেনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমরা প্রত্যেকেই নিজ অধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব, নেতা, যিনি জনগণের দায়িত্বশীল, তিনি তাঁর অধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ গৃহকর্তা তার পরিবারের দায়িত্বশীল, সে তার অধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার ও সন্তান-সন্ততির ওপর দায়িত্বশীল, সে এসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।
কোনো ব্যক্তির দাস স্বীয় মালিকের সম্পদের দায়িত্বশীল, সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব, জেনে রেখো, প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’
(বুখারি, হাদিস : ৭১৩৮
আলোচ্য হাদিসে আমানত বলতে ব্যাপক অর্থে সর্বস্তরের দায়িত্ব বোঝানো হয়েছে।
মা-বাবার দায়িত্ব হলো সন্তানদের আদব-আখলাকে সচ্চরিত্রবান করে গড়ে তোলা, প্রয়োজনীয় জ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
শিক্ষকের কর্তব্য হলো পূর্ণরূপে পড়ানোর হক আদায় করা এবং এতে কোনো ধরনের অবহেলা না করা। বেতন বা পারিশ্রমিক পাওয়ার পরও বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে অভিভাবকদের থেকে অর্থ আদায় না করা।
বিচারকের দায়িত্ব হলো ন্যায়বিচার করা, নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেও হক বিচার থেকে সরে না আসা। ব্যবসায়ীর দায়িত্ব হলো পণ্যে ভেজাল না দেওয়া, জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়—এমন কোনো কাজ না করা, ওজনে কম না দেওয়া, ক্রেতাকে প্রতারিত না করা।
শ্রমিকের কর্তব্য হলো পূর্ণভাবে কাজের দায়িত্ব পালন করা, কাজে ফাঁকি না দেওয়া। মালিকপক্ষের ক্ষতি সাধন হয় এমন কোনো কাজ না করা। এভাবে সব শ্রেণির সব পেশার দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের হুঁশিয়ার থাকা এবং নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা। কেননা দায়িত্ব হলো আমানত। আর এ আমানত সম্পর্কে আল্লাহর কাছে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। অতএব, সাবধান!
প্রশাসনিক কাজে বিশ্বস্ত লোক নিয়োগ প্রদান
মহান আল্লাহ বলেন, ‘প্রকৃত মুমিন তারাই, যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।’
(সুরা : মুমিনুন, আয়াত : ৮)
হুজায়ফা (রা.) বলেন, ‘নাজরান এলাকার দুজন সরদার আকিব ও সাইয়িদ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে তাঁর সঙ্গে মুবাহালা করতে চেয়েছিল। বর্ণনাকারী হুজায়ফাহ (রা.) বলেন, তখন তাদের একজন তার সঙ্গীকে বলল, এরূপ কোরো না। কারণ আল্লাহর কসম! তিনি যদি নবী হয়ে থাকেন আর আমরা তাঁর সঙ্গে মুবাহালা (পরস্পরকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে অভিসম্পাত) করি তাহলে আমরা এবং আমাদের পরবর্তী সন্তান-সন্ততি (কেউ) রক্ষা পাবে না। তারা উভয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলল, আপনি আমাদের কাছে যা চাইবেন আপনাকে আমরা তা-ই দেব। তবে এ জন্য আপনি আমাদের সঙ্গে একজন আমানতদার ব্যক্তিকে পাঠিয়ে দিন। আমানতদার ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তিকে আমাদের সঙ্গে পাঠাবেন না। তিনি বলেন, আমি তোমাদের সঙ্গে প্রকৃতই একজন আমানতদার পাঠাব। এ পদে ভূষিত হওয়ার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবিরা আগ্রহান্বিত হলেন। তখন তিনি বললেন, ‘হে আবু উবায়দাহ ইবনুল জাররাহ! তুমি উঠে দাঁড়াও। তিনি যখন দাঁড়ালেন, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, এ হচ্ছে এই উম্মতের সত্যিকার আমানতদার।’ (বুখারি, হাদিস : ৪৩৮০)
দেশ ও জাতির কল্যাণে আমানতদার নেতৃত্ব
বিশ্বস্ত আমানতদার, যোগ্য ও মেধাবী ব্যক্তি বর্তমানে সমাজে অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত। মাতাপিতার সীমাহীন ত্যাগে গড়ে ওঠা মেধাবী সন্তান আজ অযোগ্যদের টাকা/ক্ষমতার দাপটের কারণে ন্যায্য পদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনসহ সর্বত্র আজ অযোগ্য লোকদের দৌরাত্ম্য চলছে, যা দেশ ও জাতির ধ্বংসের অশনিসংকেত।
এ শ্রেণির লোকেরাই আজ সামাজিকভাবে সমাদৃত ও গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.) এই নিন্দিত বাস্তবতার বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন আমানত নষ্ট হয়ে যাবে, তখন কিয়ামতের অপেক্ষা করবে। বর্ণনাকারী বলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমানত কিভাবে নষ্ট হয়ে যাবে? তিনি বলেন, যখন অযোগ্য ব্যক্তিকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হবে, তখন কিয়ামতের অপেক্ষা করবে। (বুখারি, হাদিস : ৬৪৯৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই মানুষ এমন শত উটের মতো, যাদের মধ্য থেকে তুমি একটিকেও বাহনের উপযোগী পাবে না।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪৯৮)
অর্থাৎ উটের কাজ হলো বোঝা বহন করা। আর যে উট বোঝা বহন করতে পারে না, সেটা নিজেই একটা বোঝা। অনুরূপভাবে মানুষ আজ নামে মাত্র মানুষ। তার দেহসৌষ্ঠব সুন্দর হলেও শত মানুষের মধ্যে মানবিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন