কথিত আছে যে এক হিংসুটে লোক তার প্রতিবেশীকে বলছে, ‘তোমার ছেলে পরীক্ষায় পাস করবে না।’ ছেলেটি যখন পরীক্ষায় পাস দিল, তখন ছেলের বাবাকে বলা হলো, ‘পাস দিয়েছে তো কী হয়েছে, এই ছেলে কোনো দিন চাকরি পাবে না।’ ছেলেটি যখন সত্যি সত্যি চাকরি পেয়ে গেল, তখন বলা হলো, ‘ছোকরা চাকরি পেল বটে, কিন্তু বেতন পাবে না।’ অবশেষে বেতন পাওয়ার পর হিংসুটে লোকটি তার প্রতিবেশীকে যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে, বেতন পাওয়া আর সুখে থাকা এককথা নয়। যদি বলি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, অভ্যুদয় এবং অগ্রযাত্রার প্রতিটি ধাপে সমালোচকদের মন্তব্য ছিল অনেকটা ওই হিংসাপরায়ণ ব্যক্তিটির মতো, তাহলে বোধ হয় ভুল কিছু বলা হবে না।
দুই
এ ব্যাপারে অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, তবে আপাতত দু-একটি উল্লেখ না করলেই নয়। সদানন্দ ধুম নামে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক কলামিস্ট বেশ কয়েক বছর আগে একটি মন্তব্য ছুড়েছিলেন : প্রায় ৪০ বছর আগে শুধু একজন বেপরোয়া আশাবাদী ছাড়া অন্য কেউ অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধিশালী পাকিস্তানের বিপরীতে বন্যাপ্রবণ, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ওপর বাজি রাখতে চাইত না। যাঁরা সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখতেন, হেনরি কিসিঞ্জারের নিষ্ঠুর মন্তব্য ‘বাংলাদেশ ইজ অ্যান ইন্টারন্যাশনাল বাসকেট কেস’, তাঁদের সেই স্বপ্ন ধ্বংস না করলেও যে বিরাট একটি ধাক্কা দিয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
১৯৭৫ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ইজ আ টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’ বইটিতে আরো একটি অপেক্ষাকৃত শ্বাসরুদ্ধকর মন্তব্য করেছিলেন ইউস্ট ফাল্যান্ড ও জে পারকিনসন : যদি বাংলাদেশ উন্নয়নের ছোঁয়া পায়, তাহলে পৃথিবীর এমন কোনো দেশ থাকবে না, যেখানে উন্নয়ন ঘটবে না। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি তখন এত বৈরী ছিল যে এমনকি একজন উদ্দাম আশাবাদীও তৎকালীন সময়ে সবেমাত্র জন্ম নেওয়া দেশটির অর্থনৈতিক সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে কোনো আলো খুঁজে পাননি। হতাশার আগুনে ঘি ঢেলেছিল তৎকালীন রাজনীতি ও প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের দুর্বল নৈতিক অবস্থান।
তিন
এখন বাস্তবতা এই যে কঠিন দুঃসময়ের মধ্যেও বাংলাদেশ প্রশংসনীয়ভাবে টিকে থাকতে পেরেছে, যদিও দেশটিকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সংকট মোকাবেলা করতে হচ্ছে; যেমন- মানুষের স্বাধীনতার অভাব, স্বৈরাচারী কাঠামো, দুর্নীতি ইত্যাদি। আরো আছে পড়ন্ত ভূমি-মানুষ অনুপাতের বিরূপ প্রভাব, দুর্বল প্রাকৃতিক সম্পদ ভিত, কুশাসন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রতিনিয়ত আক্রমণ, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ইত্যাদি। এত কিছুর পরও মেঘের আড়ালে যেমনি সূর্য হাসে, বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেশটির অবিশ্বাস্য রকমের কৃতিত্ব আশার আলো প্রজ্বলিত করে। গর্বের সঙ্গে বলতে হয়, বাংলাদেশের বর্ণনা এবং ভাবমূর্তি এখন ভীষণ রকম বদলে গেছে। ১৯৭৪ সালে বন্যা-পরবর্তীকালে বাংলাদেশে প্রকট খাদ্যাভাবের সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু ১৯৮৮ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে তার চেয়ে বেশি ব্যাপৃত বন্যার সময় দেশ-বিদেশে যাঁরা দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন, বছর পেরিয়ে না যেতেই বুঝতে পারলেন যে তাঁদের সেই ধারণা সঠিক ছিল না।
১৯৭৪ সালে ভিজিএফ কার্ড বলে কোনো কিছু ছিল না এবং ওরস্যালাইনের কল্পনা ছিল একপ্রকার বাতুলতা।
আজ কয়েক দশক পর বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা রোল মডেল। বিভিন্ন গবেষণা অধ্যয়ন থেকে বেরিয়ে আসছে যে সময়ের বিবর্তনে মাথাপিছু প্রকৃত জিডিপি পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে; প্রত্যাশিত আয়ু ৫০ বছর থেকে ৭৩ বছরে উঠেছে; জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বার্ষিক ৩ থেকে ১.২ শতাংশে নেমেছে; শিশুমৃত্যুর হার প্রতি এক হাজার জন্মে ২৪০ থেকে ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে; সাক্ষরতা বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি; ক্ষুদ্রঋণের কল্যাণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দেশটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে লিঙ্গসমতা অর্জনে সমর্থ হয়েছে। সুসংবাদের এখানেই শেষ নয়, আন্তর্জাতিক রেটিংয়ে বাংলাদেশের স্থান ক্রমাগত উন্নতির দিকে যাচ্ছে।
চার
তবে এই জেগে ওঠা যে বাংলাদেশের আদি সমালোচকদের ভবিষ্যদ্বাণীকে মোটামুটি মিথ্যা প্রমাণিত করতে পেরেছে, সে কথাটি স্বয়ং সমালোচকদের মুখ থেকেই বেরিয়ে এসেছে। যাঁরা স্বাধীনতার শুরুতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ইউস্ট ফাল্যান্ড ও জে পারকিনসন ৩২ বছর পর ২০০৭ সালে বাংলাদেশে এসে বলে গেলেন, প্রারম্ভিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ উন্নয়নের একটি প্রকৃত টেস্ট কেসের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, যদিও নিশ্চিত করে বলার সময় আসতে অনেক বাকি, এই মুহূর্তে এবং তিন দশকের অধিক সীমিত এবং সুখ-দুঃখের অগ্রগতি দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন হাতের নাগালের মধ্যে। বর্তমানে বাংলাদেশ যে সমস্যার সম্মুখীন; যেমন- রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সম্পদ আয়ের অসম বণ্টন উভয় ক্ষেত্রেই, অন্যান্য দেশে তাদের নিজের মতো করেই সেসব সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান।
পাঁচ
তুলনার কথাটি যখন এসেই পড়ল, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির একটি তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন করা প্রাসঙ্গিক বলে আমরা মনে করি। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধকালে অবকাঠামোগত ধ্বংস ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার কারণে সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি পিছিয়ে থাকলেও সম্প্রতি দেশটির প্রবৃদ্ধির হার পাকিস্তানের হারকে ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয়ত, সামাজিক নির্দেশকগুলোতে বাংলাদেশ যে ব্যাপক উন্নতি করেছে, তাতে একসময় এগিয়ে থাকা পাকিস্তান পিছিয়ে পড়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর এবং অসাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদবিরোধী অবস্থানের বিপরীতে পাকিস্তানে জঙ্গিবাদের উত্থান ও গণতন্ত্রের জায়গায় সামরিকতন্ত্রের প্রভাবের কথা আপাতত না-ই বা বলা হলো। সুতরাং যারা স্বাধীনতার বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে যাচ্ছিল এই বলে যে পাকিস্তান ছেড়ে এলে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বে, তাদের জন্য বাংলাদেশের তুলনামূলক ভালো অর্জন বুক চাপড়ানো উন্নয়ন-ধাঁধা হিসেবে থাকছে বলে মনে হয়। ভারতের বিপক্ষেও অর্জন অনেক আশাব্যঞ্জক। স্বয়ং নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মাথাপিছু আয়ের পার্থক্যটা ক্রমেই কমতির দিকে।
ছয়
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে এক গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটে এবং জনগণের স্ফীত প্রত্যাশা সামনে রেখে একটি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। গেল এক বছরে সরকারের সাফল্যের ঝুড়িতে বেশ কিছু পদক্ষেপ প্রশংসা কুড়িয়েছে; যেমন- ব্যাংকিং খাতের নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ, বৈদেশিক মুদ্রার মান সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা ইত্যাদি। কিন্তু বিষম রকমের অভিযোগ আছে যে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিশেষত মব সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণে সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। এই ব্যর্থতা ঢাকতে নানা গল্প শোনানো হচ্ছে। কলকারখানায় হামলা, চাঁদাবাজি, মাস্তানি, ব্যবসায়ীদের প্রতি হুমকি ইত্যাদি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিরাট বিঘ্ন সৃষ্টি করছে বলেও অভিযোগ উঠছে। এমতাবস্থায় প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকারের কাছে ক্ষমতা যাওয়া উচিত বলে ধারণা অভিজ্ঞমহলের। সন্দেহ নেই যে রোল মডেল স্ট্যাটাস থেকে বাংলাদেশ এখন বহু দূরে। তাই আশু করণীয় হচ্ছে, চটজলদি নির্বাচন কমিশন সংস্কারের মাধ্যমে ঘোষিত সময়ে দেশে নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক, কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত একটি ন্যায়সংগত নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। আমরা চাই না যে বাংলাদেশ পরিচিত হক প্রত্যাশা পূরণের ব্যর্থতার রোল মডেল হিসেবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।