বাংলাদেশে বর্তমানে মানুষ হত্যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে সামাজিক নৃশংসতা ও বীভৎস হত্যাকান্ড। দেশজুড়ে একের পর এক ভয়াবহ খুন, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও সহিংসতায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে সাধারণ মানুষ। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ইত্যাদি কারণে বেড়ে চলছে নিরাপত্তাহীনতা। গণপিটুনি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ ও হত্যাকান্ড এখন প্রায় নিত্যদিনের খবর। এ বর্বর নৃশংস পরিস্থিতি আজ সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। পরিবার, প্রতিবেশী এবং সমাজের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। যার কারণে অনেক ক্ষেত্রে পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাব তৈরি হচ্ছে। ইসলাম শান্তির ধর্ম সন্ত্রাস, হত্যা, আত্মহত্যা, চাঁদাবাজি এবং সব সামাজিক অপরাধ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কাউকে হত্যা করা ইসলামের আলোকে মারাত্মক অপরাধ। ইসলাম সব ধরনের অপরাধ আইনের মাধ্যমে সমাধানের নির্দেশ দেয়। একটা নির্দোষ প্রাণ হত্যা করা, গোটা মানবজাতি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য। ইসলাম ধর্ম মানবজীবনকে অত্যন্ত পবিত্র ও মূল্যবান মনে করে। ইসলাম মানবজীবনকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছে এবং এর সুরক্ষায় কঠোর বিধান আরোপ করেছে। ইসলামি বিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কাউকে হত্যা করা শুধু অপরাধ নয় বরং মহান আল্লাহর সঙ্গে চরম বিদ্রোহ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত হত্যা-সম্পর্কিত শাস্তির বিধানগুলো সমাজে শান্তি, নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করে তার শাস্তি জাহান্নাম। সেখানে সে চিরকাল থাকবে।’ (সুরা আন নিসা আয়াত-৯৩)। আরেক আয়াতে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘আমি বনি ইসরাইলের প্রতি লিখে দিয়েছি, যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল এবং যে কারও জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করল।’ (সুরা মায়েদা-৩২)। হত্যার শাস্তি হিসেবে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘হে ইমানদারগণ! নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কিসাস (প্রতিশোধ) ফরজ করা হয়েছে।’ (সুরা আল বাকারাহ ১৭৮)। এর মর্ম হলো যেমনটি করেছে, তেমন প্রতিশোধ হবে। খুনের পরিবর্তে খুন। তবে নিহতের পরিবার যদি ক্ষমা করে, তাহলে দিয়ত বা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যেসব বিষয়ে বিচার হবে তার প্রথমটি হচ্ছে রক্তপাত সম্পর্কিত।’ (সহিহ বুখারি)। এর আলোকে প্রমাণ হয় হত্যা একটি মৌলিক অপরাধ। যার বিচার হবে সবার আগে। আরেক হাদিসে তিনি ঘোষণা করেন, ‘একজন মুমিন তার দীনের ব্যাপারে নিরাপদ অবস্থায় থাকতে পারে, যতক্ষণ না সে কোনো নিষিদ্ধ রক্তপাত ঘটায়।’ (সহিহ বুখারি)। বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের রক্ত ও সম্পদ আজকের এই দিন, এই মাস এবং এই শহরের মতো পবিত্র ও সুরক্ষিত, ওই দিন পর্যন্ত, যেদিন তোমরা তোমাদের রবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে।’ (সহিহ বুখারি)। মহানবী (সা.) মানব হত্যাকে অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছেন, ‘তিনি বলেন, সব পাপ আল্লাহতায়ালা ক্ষমা করবেন বলে আশা করা যায়, কিন্তু যে ব্যক্তি কুফরি অবস্থায় মারা যায় অথবা যে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করেন সে এই বিবেচনার বাইরে।’ (আবু দাউদ)। খুনি ব্যক্তি আল্লাহর কাছে সর্বাধিক ঘৃণিত। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত। এক. যে ব্যক্তি হারাম শরিফে অন্যায় ও অপকর্মে লিপ্ত হয়। দুই. যে ব্যক্তি ইসলাম-পূর্ব জাহেলি যুগের রেওয়াজ-প্রথা অনুসরণ করে। তিন. যে ব্যক্তি বিনা অপরাধে কেবল খুন খারাবির উদ্দেশ্যে কোনো মুসলমানের রক্তপাত কামনা করে।’ (সহিহ বুখারি)। অন্যকে হত্যা করার দ্বারা মানুষ নিজের ধ্বংস ত্বরান্বিত করে। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, ‘যেসব অপরাধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার পর তার ধ্বংস থেকে আত্মরক্ষার উপায় থাকে না, সেগুলোর একটি হলো, কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা। ইসলাম হত্যা, সন্ত্রাসকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে এবং এর জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে কঠোর শাস্তির ঘোষণা দিয়েছে। ইচ্ছাকৃত হত্যার জন্য চির জাহান্নাম, আল্লাহর গজব ও সমাজে প্রতিশোধ অথবা আর্থিক দন্ডের বিধান প্রবর্তিত করেছে। বাংলাদেশের চলমান হত্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনের কঠোর প্রয়োগ, দ্রুত বিচার নিশ্চিতকরণ এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা একান্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে ইসলামি বিধিবিধানের, নৈতিক শিক্ষা ও শাস্তির বিধানগুলো সমাজের শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
♦ লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা