আমার মা স্থানের মানুষ, সময়ের নন। স্থান ও কালের ভিতর যে একটা কার্যকর পার্থক্য রয়েছে, দুয়ের মধ্যে কখনো কখনো যে বিরোধও বাঁধে, তার প্রমাণ আমি ঘরের ভিতরেই দেখতে পাই, আমার মায়ের জীবনে। তিনি সময়ের ভিতরে ছিলেন নিশ্চয়ই, অবশ্যই; কিন্তু সময়ের অধীনে ছিলেন বলে কখনো মনে হয়নি আমার। আমার পিতা বরং অনেক বেশি আজ্ঞাবহ ছিলেন সময়ের। আর পাঁচজন মধ্যবিত্ত পিতার মতোই তাঁরও আগ্রহ ছিল সময়কে ধরবেন, আর কিছু না পারুন অন্তত তাল রেখে তো চলবেন, তিনি না পারলে তাঁর সন্তানেরা টিকে থাকবে প্রতিযোগিতায়। ওই কাজটা সন্তানেরা করতে পারবে কি না সে নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। আমার মাতা সেটা ছিলেন না। তিনি সংসারী ছিলেন না এমন দুর্নাম করার কোনো উপায়ই নেই, উদাসীন্য তাঁর ভিতরে দেখিনি আমরা একদিনও। এমনকি দীর্ঘ সময় ধরে মনমরা হয়ে থাকবেন এমন সুযোগও তাঁর ছিল না। তটস্থ থাকতেন সংসার নিয়ে। ‘আমি ভয় পেলে কি হবে আমার রান্নার চুলা যে ভয় পায় না’, কিংবা তাঁর তেরোটি সন্তানকে বলতেন, ‘তোরা আমাকে টুকরো টুকরো করে নিয়ে নে’- এরকমের কথা বহুবার শুনেছি তাঁর মুখে। এমন নিপুণ ছিল কর্তব্যপরায়ণতা ও কর্মব্যস্ততা যে, বাইরের সময় মনে হতো ঢুকতেই পারবে না তাঁর ওই নিজস্ব জগতে। কিন্তু তাই বলে বলা যাবে না যে, তিনি আবদ্ধ ছিলেন শৃঙ্খলে। তাঁর জন্য সবকিছুই ছিল লতাপাতাগুল্ম, এমনকি দড়ি রশি পর্যন্ত নয়। ধর্মেকর্মে নিষ্ঠা ছিল অসংশোধনীয়, তাহাজ্জুদের নামাজ ও সাক্ষী রোজা বাদ দিতেন না; কিন্তু ছিলেন একেবারেই অসাম্প্রদায়িক। তাঁর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব ছিল গোয়ালনীর মায়ের, যিনি অন্য সম্প্রদায়ের, এবং যিনি এসে থেকে গেছেন আমাদের ঢাকার বাসায়, মায়ের হাতে রান্না খেয়ে। রাজশাহীতে একটি ধোপা পরিবার ছিল, যার প্রধানের নামানুসারে নাম দেওয়া হয়েছে আমার এক ভাইয়ের।
ঘর-সংসার তো নোংরা জায়গা, আবর্জনায় আচ্ছন্ন, কিন্তু তাই বলে নোংরামির গ্লানি যে তাঁকে কাবু করবে তেমনটা ঘটেনি। ওদিকে শুচিবায়ু যে ছিল তাঁর, তাও নয়। সেটা কারও কারও থাকে, বিশেষ করে মহিলাদের; আমার মায়ের ছিল না।
না, আমার মাকে আমি মোটেও আদর্শায়িত করতে পারব না। একেবারেই অসম্ভব। খুব ছোটখাটো হালকাপাতলা মানুষটি তিনি, যেন বিন্নি ধানের খই। উঁচু নন, নিচু নন, নিতান্তই স্বাভাবিক, এবং সর্বদাই জীবন্ত। আশি পার হওয়ার পরও ছিলেন চলিষ্ণু, সজীব তো অবশ্যই, গুনগুন গানের মতো, নীরবতাটা স্তব্ধতা নয়, চলমানতার রেশ। ক্ষমতাবান তাঁকে কেউ কখনো বলবেন না, কোনো বিবেচনাতেই নয়। কিন্তু ভিতরে একটা শক্তি ছিল, যেটা ভিন্ন ব্যাপার। ক্ষমতা সর্বদাই প্রতিপক্ষ চায়, নিজেকে প্রকাশ্য, পরীক্ষিত, প্রমাণিত করার জন্য। শক্তি নিজে নিজেই থাকতে পারে, নিজের মধ্যে। শান্ত। অন্তর্গত শক্তির পক্ষে শিং ঘষাটা অনাবশ্যক, নিজেকে জানিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনে।
তা যতই যা বলি না কেন, তিনি আদর্শায়িত হতে কিছুতেই সম্মত হবেন না। খাপে কিংবা খাঁচে তাঁকে ফেলা যাবে না, ফেলতে গেলে ওগুলো যে ভেঙে ফেলবেন তা নয়, সরে যাবেন, নিঃশব্দে। যেন কৌতুকভরে। আমার মায়ের পক্ষে বিদ্রোহ অকল্পনীয়। তাঁর প্রজন্মের জন্য যেমন তাঁর নিজের জন্যও তেমনি বিবাহটা ছিল প্রতিষ্ঠান ও অবস্থান, সংসার অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য। বিদ্রোহ নেই, নালিশও নেই, কার কাছে করবেন নালিশ, কোথায় আছে সুবিচার? কত যে গঞ্জনা তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে কে তার হিসাব রাখে; তাঁর সঙ্গেই তো ঝগড়া ছিল আমাদের, আব্বার সঙ্গে নয়। সর্বজ্যেষ্ঠ থেকে সর্বকনিষ্ঠ পর্যন্ত সবাই তাঁকে তুমি বলে; আমার পিতাকে যেমন বলত আপনি। অন্য কিছু বলার কথা ভাবিইনি আমরা। কিন্তু তবু সংজ্ঞা দেওয়া যাবে না তাঁর; গানের সংজ্ঞা গান ছাড়া আবার কী!
এর একটা অতিরিক্ত কারণ কি এই যে, তাঁকে স্মৃতিতে দেখতে পাই, আমার পরলোকগত পিতাকে যেমনটা দেখি, এবং আমার স্ত্রীকেও। কিন্তু মূল কারণ সেটা নয়। আসল ব্যাপার এই যে, তিনি ধরা দেবেন না একটা কাঠামোতে, স্মিত, হয়তোবা দুষ্টুমিভরা হাস্যে সরে যাবেন। সংলগ্ন থাকতে চান, আগ্রহ নেই স্বতন্ত্র হওয়ার। কাজেই বাইরে তাঁকে দেখিনি। অসুখবিসুখ হয়েছে নিশ্চয়ই, কিন্তু হাসপাতালে যেতে হয়নি। অনেক পরে গেছেন একাধিকবার। কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর সেরকমের আপত্তি ছিল না, যেমনটা আমার পিতার ছিল। আমার বাবা হাসপাতালকে বড় ভয় করতেন। সেখানকার গন্ধটা তাঁর জন্য বিশেষভাবে অপ্রীতিকর ছিল, অন্য সবকিছু তো বটেই। আব্বা যে চিরকালের জন্য চলে গেছেন সে ঘটনা গৃহেই ঘটেছে। আমার মেডিকেল-পড়ুয়া ভাইটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এসে দেখে তিনি নেই, চলে গেছেন।
কাজ থেকে মাকে আলাদা করা কঠিন ছিল, কিন্তু তবু তাঁর নিজের সংসার তাঁর তত্ত্বাবধানেই চলেছিল। উগ্র নন, দুপুরের রোদ নন, বিকালের মতো ছায়াছায়া, তাও বুঝিবা শীতবিকালের। অথচ সজীব। এমন মানুষটিকে কী করে বলব আমি প্রতীক কোন নির্দিষ্ট ভাবমূর্তির, কিংবা আদর্শের? এ যে তুলনা দিচ্ছি দুচারটি সেও তাঁকে বোঝানো কঠিন বলেই, অন্য কারণে নয়।
তবে ওই যে বলছিলাম, আমার মা সময়ের মানুষ নন, স্থানের মানুষ, সেটি বড়ই সত্য কথা। কিন্তু সময় তো তাঁকে ক্ষমা করেনি। ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত উভয় সময়ই তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল, নিজস্ব দাঁত ও নখ দিয়ে। দেখেছেন বহু কিছু, সহ্য করেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি। অনেকটা আমাদের দেশের, এই যে আমাদের মাতৃভূমি, তারই মতো। আমার মায়ের জগৎটা খুবই ছোট ছিল, এই বাংলাদেশের মতোই।
২
সময়টা ছিল অস্থির, কেবল অস্থির নয়, কখনো কখনো সে রূপ নিয়েছে ভয়ংকর। ওই সময়ের হাতে নিগৃহীত হয়েছে মানুষ, বিশেষ করে মেয়েরা। আমার মা অনেক কিছুই দেখেছেন। বিশেষভাবে সেগুলো যেগুলো গায়ে এসে লেগেছে। কালের নন, তবু কালের সাক্ষী তো বটেই, বাংলাদেশের মতোই। ঘটনাগুলোর মধ্যে বৈচিত্র্য রয়েছে, তারা বেশ স্বতন্ত্র, পরস্পর থেকে, কিন্তু আবার ঐক্যও আছে, রয়েছে ধারাবাহিকতা, কেননা সংলগ্ন ছিল তারা একটি ধারাপ্রবাহের সঙ্গে, প্রবাহটা হলো পুঁজিবাদের অগ্রসরমনতার। এক ধরনের পুঁজিবাদ তার নিজের মতো করে অগ্রসর হচ্ছিল। প্রথমে ধীরে, পরে প্রবলভাবে। লোমশ, দুর্গন্ধমেদুর। আমার মায়ের পক্ষে এটাকে চিহ্নিত করতে পারার কথা নয়, তিনি তা করেনওনি। ওইভাবে তাঁরা তৈরি হননি। কিন্তু অভিজ্ঞতাগুলো তাঁদের সহ্য করতে হয়েছে। তারিখ ও বিশদ কোনোটাই বলতে পারতেন না, কিন্তু অনুভূতি বড় সত্য ছিল।
সেই সময়ে তাঁর জন্ম যখন একটি বিশ্বযুদ্ধ মাত্র শেষ হয়েছে, এবং প্রস্তুতি চলছে আরও একটি যুদ্ধের। ওই বিশ্ব থেকে আমার মা অনেক দূরে। বলাই বাহুল্য। কিন্তু বিশ্ব আঘাত করতে ছাড়েনি তাঁকেও, তাঁদের গ্রামকেও। পঞ্চাশের মন্বন্তর দেখেছেন। শহরে ছিলেন না, ছিলেন গ্রামেই। আমার মা সব সময়েই গ্রামের মানুষ, গ্রামের সঙ্গে তাঁর স্বাভাবিক আত্মীয়তা। সেখানে দারোয়ান নেই, দেয়াল নেই। গাছপালা, পুকুর, বর্ষাকাল এসব তাঁর অত্যন্ত প্রিয়, যদিও তাঁর জীবনের চৌদ্দআনাই কেটেছে শহরে; বিয়ের পরে গ্রামে যখন গেছেন, থাকতে যাননি, গেছেন বেড়াতে। তাঁর নিজের ইচ্ছার ওপর কিছুই নির্ভর করেনি, করলে তিনি গ্রামেই থাকতেন।
যুদ্ধ গ্রামকেও আঘাত করেছে বৈকি। তারপর খুব বড় ঘটনা ঘটল, সাতচল্লিশে বাংলা ভাগ হয়ে গেল। মনে করা হলো স্বাধীনতা এসেছে। তারপর আবার, দ্বিতীয়বার এলো স্বাধীনতা, একাত্তরে। প্রথমবার ঘটেছিল দাঙ্গা, দ্বিতীয়বার ঘটল যুদ্ধ। এই দুই স্বাধীনতার কোনোটাই বিশেষ কোনো সুখ বয়ে আনেনি আমার মায়ের জন্য। ঝুঁকি এনেছে অনেক।
সাতচল্লিশে কলকাতায় ছিলেন। কলকাতায় দাঙ্গা যখন অত্যন্ত প্রচণ্ড তখন তিনি রাজশাহীতে। ছেচল্লিশের শেষে তিনি কলকাতায়। দাঙ্গা তখন শেষ হয়েও হয়নি। বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটছে। নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্ক সর্বত্র ব্যাপ্ত। আমার মনে আছে এক সন্ধ্যায় আমার বাবা বাসায় ফিরতে দেরি করেছিলেন। বলে যাননি যে অফিস শেষে এক আত্মীয়ের বাসায় যাবেন, যাওয়ার কথাও হয় তো ছিল না। সেই সন্ধ্যার উদ্বেগ আমি এখনো ভুলিনি। আমি ট্রাম স্টপেজে গিয়ে অপেক্ষা করছি কখন বাবা ফেরেন। মা কাজের মধ্যে বিশেষভাবে ব্যস্ত রেখেছেন নিজেকে, উদ্বেগ চাপা দেওয়ার চেষ্টায়। ওই রকমেরই নাজুক ছিল পরিস্থিতি। নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য আমাদের পিতারা তখন এক রকমের পোশাক পরতেন যেটাকে পরিহাস করে বলতেন প্যান্ট-পাজামা, মুসলমান এলাকাতেই চলাফেরা ছিল বেশি, সেখানে ওই পরিধেয় পাজামা হিসেবে গণ্য হবে, অন্য এলাকায় বিবেচিত হবে প্যান্ট বলে, অর্থাৎ কিনা পরিধানকারী হিন্দুও হতে পারে, মুসলমানও। সরাসরি চিহ্নিত করায় অসুবিধা ঘটবে। একাত্তরে আতঙ্কটা ছিল অনেক বড় ও অসম্ভব রকমের নিকটবর্তী। লাশ রক্ত ও আর্তনাদে আচ্ছাদিত তখন বাংলাদেশ। সেই সময়ে আমার বাবা জীবিত নেই, চলে গেছেন তিনি পঁয়ষট্টিতে, থাকলে মর্মান্তিক কষ্টে পড়তেন, যেমন আমার মা পড়েছিলেন। শহর ছেড়ে তাঁকে গ্রামে যেতে হয়েছিল, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। সাতচল্লিশের চৌদ্দই আগস্টে আমার মা গ্রামে, একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বরেও তিনি সেখানে। গ্রামেই। স্বাধীনতা তাঁকে কষ্ট দিয়েছে বিস্তর। সাতচল্লিশের পরে ঢাকায় বাসা হয়েছে তাঁর, কিন্তু দেশে তখন প্রায় দুর্ভিক্ষের তৎপরতা। রেশন কার্ড, কার্ডে পচা চাল, অখাদ্য গম, লালচে চিনি, অপরিচ্ছন্ন লবণ এসব সংগ্রহ সহজ কাজ ছিল না। একই ব্যাপার একাত্তরের পরেও, ওই ঢাকা শহরেই। চালের দাম হু হু করে বাড়ছে, রেশন কার্ড পাওয়া মস্ত বড় সৌভাগ্য। রেশনের দোকানে লাইন দিতে হয় মধ্যরাতে গিয়ে। কাকে পাঠাবেন, কখন পাঠাবেন ভেবে অস্থির থাকতেন। পরে তো সত্যি সত্যি দুর্ভিক্ষই দেখা দিল, চুয়াত্তরে।
গ্রাম কোনো সুখকর জায়গা ছিল না, কিন্তু সেখানে একটা বিস্তার ছিল। শহরে গিয়ে আমার মা সেই বিস্তার হারিয়েছেন। ক্রমাগত সংকোচন ঘটেছে স্থানের। সময় বৈরিতা করেছে, মিত্রের বেশে। অনেক বছর কেটেছে তাঁর রাজশাহীতে। সেই শহর ছোট বটে, তবু শহর তো, এবং অনেক দূর আমার মায়ের বিক্রমপুর থেকে। পুকুর নেই, তার বদলে নির্ভরশীলতা কুয়ার ওপর। খাবার পানি আসে রাস্তার ঢপ কল থেকে। তবু যা হোক একটা প্রসারতা ছিল, সদর অন্দর মিলে। একতলা বাড়ি, অনেকগুলো কামরা, সামনে পেছনে বিস্তর জায়গা। অনেকাংশ খালি পড়ে থাকে। গাছপালা আছে আশপাশে। পাখি ডাকে। খাল প্রবহমান বাড়ির পাশে, বর্ষায় পদ্মার ছেড়ে দেওয়া পানি যেখানে উপচে পড়ে। রাজশাহীতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমার মায়ের আত্মীয়তা গড়ে উঠতে দেরি হয়নি। প্রকৃতই সামাজিক ছিলেন তিনি, মনে আছে।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়