সংকটের মুখে বস্ত্র খাত। গ্যাস-বিদ্যুতে বাড়তি খরচ, সুতার লাগামহীন দাম, আমদানিনির্ভরতা, নীতি সহায়তার অভাব, প্রণোদনা কমানো ও মূল্য সংযোজনের অভাবে রপ্তানিমুখী বস্ত্র খাত লোকসানের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। চালাতে ব্যর্থ হওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় একটি বস্ত্র কারখানা এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে চাকরি হারিয়েছেন অন্তত ১২ হাজার কর্মী। আর বিনিয়োগ ক্ষতি হয়েছে প্রায় তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকার। এ খাতে গত আট মাসে মোট বেকার হয়েছেন প্রায় ২৬ হাজার শ্রমিক। দীর্ঘ মেয়াদে এ শিল্পের টিকে থাকা নিয়ে উদ্যোক্তারা উদ্বিঘ্ন বলে তাঁরা জানিয়েছেন।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, প্রতিযোগিতা ও নীতিগত বৈষম্যের ফলে ভারত ও চীনের তুলনায় কম ভর্তুকি ও ব্যবসাবান্ধব নীতিগত সহায়তা পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশে (এলডিসি) উত্তরণ উপলক্ষে প্রণোদনা কমানোয় রপ্তানিতে চাপ তৈরি হয়েছে। ফলে সার্বিকভাবে পোশাকের মূল্য সংযোজন কমছে।
বিটিএমইএর তথ্য অনুসারে, পোশাক খাতে বছরে ৪৭৮ কোটি ডলার লাগে। এর মধ্যে ২০২৪ সালে সুতা আমদানি হয়েছে ২২৮ কোটি ডলারের। আর স্থানীয়ভাবে জোগান দেওয়া হয় ২৫০ কোটি ডলারের। এদিকে স্থানীয়ভাবে ৩৮২ কোটি ডলারের সুতার জোগান দেওয়ার সক্ষমতা থাকলেও বাকি ১৩২ কোটি ডলারের সুতা আমদানির ফলে বছরে ১৩২ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে বাংলাদেশ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বস্ত্র খাতের একজন উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, জ্বালানিসংকট এবং আমদানি বাড়ায় প্রতিদিন ১০ লাখ কেজির সুতা তৈরির সক্ষমতাসম্পন্ন একটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ ক্ষতিতে আছেন উদ্যোক্তা। সক্ষমতার দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় স্পিংনিং মিলটি গত ছয় মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে উদ্যোক্তা প্রায় দেউলিয়া হয়ে গেছেন। কারখানার ১২ হাজার কর্মীও চাকরি হারিয়েছেন।
বিটিএমএ পরিচালক লিটল স্টার স্পিনিং মিলসের চেয়ারম্যান মো. খোরশেদ আলম বলেন, ‘বস্ত্র খাতে গত আট মাসে ২৬ হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। আর গত ছয় মাসে স্পিনিং খাতের দক্ষিণ এশিয়ার বড় কারখানাগুলোর মধ্যে একটি বড় স্পিনিং কারখানা বন্ধ হয়েছে। এই কারখানা বন্ধ হওয়ার ফলে মোটা বিনিয়োগ ক্ষতি হয়েছে ও বিপুল কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে গেছে।’
এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন-বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘ভিয়েতনাম, ভারত ও চীনের মতো দেশ যেখানে সরকারি প্রণোদনা পাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে ভারত থেকে প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত সুতা আমদানি হওয়ায় দেশীয় টেক্সটাইল মিলগুলো লোকসানে পড়ছে। এতে অনেক ছোট ও মাঝারি শিল্প বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায়। আর স্থানীয় উৎপাদনে স্থবিরতা মানে কর্মসংস্থানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’
বিটিএমএ সভাপতি আরো বলেন, দেশের সুতা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও সরকারের ভ্রান্ত নীতির কারণে ভারত থেকে সুতা আমদানি করতে হয়। অন্যদিকে ভারত তাদের শিল্পকে অনেক প্রণোদনা দেয়। এতে শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ জন্য সরকারকে আরো সচেতন হতে হবে। এ ছাড়া সুতার মাস্টার এলসি ছাড়া ব্যাক টু ব্যাক এলসি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। কেননা, এখানে মিস ডিক্লারেশন হয়। ফলে আমদানি করা সুতার বেশির ভাগ ‘কালো বাজারে’ চলে যায়।
এ প্রসঙ্গে নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন-বিকেএমইএ জ্যেষ্ঠ সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘আমার কারখানা গত ২০ বছরে কোনো সুতা আমদানি না করলেও গত সাত-আট মাস স্থানীয় বাজার থেকে কোনো সুতা কিনিনি। প্রয়োজনীয় সুতা চীন থেকে আমদানি করি। সরকার প্রণোদনা কমিয়ে দেওয়ার ফলে পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের কম দামে সুতা আমদানি করতে হয়। কেননা স্থানীয় বাজারে সুতার দাম ১৭ শতাংশ বেশি। তবে মূল্য সংযোজন কিছুটা কমলেও উচ্চ মূল্যের পোশাক রপ্তানির ফলে দেশের পোশাক রপ্তানি ইতিবাচক ধারা অব্যাহত।’
মূল্য সংযোজনের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, মৌলিক টি-শার্ট ও সোয়েটার রপ্তানি থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ এখন ব্লেজার, জ্যাকেটসহ মেয়েদের লংজারির মতো উচ্চমূল্যের পোশাক রপ্তানি করছে। উচ্চমূল্যের পোশাকে বাংলাদেশের হিস্যা প্রায় ৩০ শতাংশ। এ অবস্থায় সরকার এলডিসি থেকে বের হতে পোশাক রপ্তানির প্রণোদনা কমালেও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) নীতিমালার মধ্যে থেকে রাষ্ট্রীয় ভতুর্কি দিতে হবে। কেননা স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষায় উন্নত দেশগুলো এখনো কোনো না কোনোভাবে ভর্তুকি দিয়ে থাকে।
এদিকে মূল্য সংযোজনের আরেকটি বড় খাত দেশের পোশাকশিল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও মোড়ক পণ্যের শিল্প। এই শিল্পের বড় সংগঠন বিজিএপিএমইএর সভাপতি মো. শাহরিয়ার বলেছেন, ‘তুৈর পোশাক শিল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই খাতের সরাসরি রপ্তানি আয় হয়েছে ১৬০ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১৪৯ কোটি ডলার। অর্থাৎ ১১ কোটি ডলারের সরাসরি রপ্তানি আয় বেড়েছে। এ ছাড়া পোশাক খাতে প্রচ্ছন্ন রপ্তানি আয় প্রায় ৮০০ কোটি ডলার। এতেও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি রয়েছে।’
শাহরিয়ার বলেন, ‘তৈরি পোশাক শিল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও মোড়ক পণ্যের বৈশ্বিক বাজার প্রায় ৯০০ বিলিয়ন ডলার। এই বাজারে বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও সরকারের নীতি সহায়তার অভাবে বিশ্ববাজারে আমাদের সক্ষমতা তুলে ধরা যাচ্ছে না। এ জন্য এনবিআরের নীতি সহায়ক না হয়ে প্রতিকূলতা তৈরি করছে।’
স্থানীয় শিল্পের অবদান বাড়ছে উল্লেখ করে উর্মি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ বলেন, সংকট থেকে উত্তোরণে উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। এ জন্য বিদ্যুৎ-জ্বালানি সমস্যার সমাধান জরুরি। এ ছাড়া নীতি সহায়তায় সমন্বয় আনতে হবে। বিশেষ করে ভারত ও চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে মূল্য সংযোজন ও ভ্যালু চেইনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ
বিডি প্রতিদিন/এমআই