মেধা-যোগ্যতার ভিত্তিতে কোটামুক্ত চাকরি হবে; সমাজে, রাষ্ট্রে বৈষম্য থাকবে না; একটা সুন্দর নতুন বাংলাদেশ হবে-এ স্বপ্নের ঘোর যেন এক বছরের মধ্যেই কেটে গেছে। যাঁরা বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরা এখন মঙ্গলগ্রহে বসবাস করছেন। মনে হচ্ছে আপাতত মর্ত্যে অবতরণ করবেন না। ক্ষমতা, অর্থ ও নারীর মোহময়ী স্রোতে বিপ্লবীরা ভেসে যাচ্ছেন। নব্য অর্থ আর ক্ষমতার এটাই ধর্ম। আর তাতে ভেঙে গেছে জাতির মেরুদণ্ড। অটোপাসের দাবিতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা রাস্তায় নামছেন। সুদিনের অপেক্ষায় ব্যবসায়ীরা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। রাজনৈতিক দলগুলোও বুঝতে পারছে না তাদের করণীয়। তাদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। রাষ্ট্র মেরামতের নামে সরকারের মতলবি উদ্যোগ। গত ১২ মাসের সালতামামি করলে শামসুর রাহমানের সেই বিখ্যাত কবিতার শিরোনামটাই যথেষ্ট, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ’।
বিপ্লব শুরুর এক বছর পূর্ণ হলো। এ সময়ের মধ্যে রাষ্ট্র, জনগণ এবং বিপ্লবের প্রত্যক্ষ ক্ষতির শিকার যাঁরা, তাঁরা কী পেলেন সে প্রশ্ন এখন দৈত্যের মতো সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্র, রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন বিশাল আয়োজন করে বিপ্লবের বর্ষপূর্তি উদ্যাপন করছে। যে মা তাঁর সন্তানকে হারিয়েছেন, যে শিশু তার পিতাকে হারিয়েছে, যে বোনটি তাঁর স্বামীকে হারিয়ে বিধবা হয়েছেন, যে পরিবার তার একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়েছে তাদের কী হবে? যে মানুষগুলো হাত, পা, চোখ হারিয়ে শরীরে অসংখ্য স্পিøন্টারের অসহ্য যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের কী হবে? সান্ত্বনা পাওয়ার মতো জ্ঞানগর্ভ বুলি আওড়িয়ে অনেকেই হয়তো বলার চেষ্টা করবেন, ‘বৃহত্তর কল্যাণের জন্য ছোটখাটো ক্ষয়ক্ষতি সহজেই মেনে নিতে হয়।’ প্রশ্ন হচ্ছে- বৃহত্তর কল্যাণের যাত্রা কি হয়েছে? বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষ্যবস্তু কী, তা কি নির্ধারণ করা হয়েছে? বৃহত্তর কল্যাণ কাদের জন্য তা কি গত ১২ মাসে দেশবাসী বুঝতে পেরেছে? এমসিকিউ পদ্ধতিতে এসব প্রশ্নের উত্তর হলো ‘না’।
দেশবাসী কি এমন বিপ্লব চেয়েছিল, যে বিপ্লবের সুফল ভোগ করে বিপ্লবীরা ক্ষমতার লোভে হিতাহিত জ্ঞান হারাবেন? আমরা যদি একটু পেছনের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, মাত্র ১১ মাস আগে জুলাই বিপ্লবীদের নাম দেশের মানুষ সম্মানের সঙ্গে উচ্চারণ করত। বয়স তিরিশের কোঠা পার না হওয়া বিপ্লবীদের জন্য অনুষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারটি সংরক্ষিত ছিল। এযাবৎ বড়রা যা পারেননি, বিপ্লবীরা তা পারবেন-এমন বিশ্বাসে বিভোর ছিল দেশবাসী। আর এখন বিপ্লবীদের দিক থেকে দেশবাসী আস্তে আস্তে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এর মূল কারণ বিপ্লবীদের আচরণ ও ক্ষমতার মোহ। সেদিনের বিপ্লবীরা এখন বিপ্লব থেকে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে ক্ষমতাকে লক্ষ করে দৌড়াচ্ছেন। ক্ষমতার স্বাদ-গন্ধ তাঁদের এখন প্রিয়। বিপ্লবীদের অনেকেরই জীবনযাপনের ধরন পাল্টে গেছে। বিপ্লবের পর দেশ মেরামতের কঠোর পরিশ্রমের কাজের যে ক্লান্তির ছাপ থাকা উচিত, তা তাঁদের চেহারায় ফুটে উঠছে না। প্রায় সবার চেহারায় এখন সুখী-সুখী ভাব। লাবণ্যের চাকচিক্য প্রকাশ পাচ্ছে। অথচ শহীদ আবদুল্লাহ বিন জাহিদের আম্মা ফাতেমাতুজ জহুরা গত মঙ্গলবার জুলাই বিপ্লব স্মরণে এক অনুষ্ঠানে অত্যন্ত হৃদয়বিদারক কিছু কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর সন্তান জাহিদ ৫ আগস্ট রাতে বিমানবন্দর থানায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে জাহিদের বয়স ছিল ১৬ বছর। দ্বিতীয় ছেলের ১৪ বছর। বড় ছেলের মৃত্যুর ১৪ দিনের মাথায় ছোট ছেলের ক্যানসার ধরা পড়ে। তা-ও আবার শেষ পর্যায়ে। জাহিদের মৃত্যুশোকে তার পিতা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক পুত্রের শোক এবং আর এক পুত্রের ক্যানসার আক্রান্তের কারণে তিনি গত ১৮ মার্চ স্ট্রোক করে মারা যান। ফাতেমাতুজ জহুরা বলেন, এই ভয়াবহ দুঃসময়ে কোনো বিপ্লবী বা সরকার তাঁর খোঁজখবর নেয়নি। সারজিস, হাসনাতকে একশবার ফোন করলেও তাঁরা ফোন ধরেন না। সরকারের কোনো উপদেষ্টাও তাঁর কোনো খোঁজ নেননি। ‘আমরা বিএনপি পরিবার’ যদি তাঁর পাশে না দাঁড়াত তাহলে তাঁকে হয়তো ভিক্ষা করতে হতো। কথাগুলো বলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি প্রশ্ন করেন-আমার সন্তানের রক্তের বিনিময়ে বিপ্লবের পর যাঁরা আজ দেশ গড়ার কথা বলছেন, তাঁরা তো এখনই আমার কোনো খবর নেন না, এর পরে আমাদের কী হবে? অথচ যাঁরা বিপ্লবের একক মালিকানা দাবি করছেন, তাঁদের নিরাপত্তায় এখন ব্যক্তিগত অস্ত্র লাগে। সেই অস্ত্রের ম্যাগাজিন আবার বিমানবন্দরে ধরা পড়ে। কোনো কোনো বিপ্লবীর আবার নারীসঙ্গ খুব পছন্দ। বিপ্লব নিয়ে নানান ধান্দাবাজি ও নয়ছয় করার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিপ্লবী উমামা ফাতেমা। সম্প্রতি তিনি তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া পোস্টে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে আমার আনুষ্ঠানিক যাত্রা এখানেই শেষ হলো। এনসিপি নামক রাজনৈতিক দলটি গঠনের পর আমি জুলাইয়ের অসমাপ্ত কাজগুলো করার দায়বদ্ধতা থেকে এ ব্যানার নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু দলীয় লেজুড় ও প্রেসক্রিপশনের বাইরে এ ব্যানারটি স্বাধীনভাবে কাজ করলে অনেকের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়ত। তাই আমার ওপর অনলাইন, অফলাইনে ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করা হয়, যাতে আমি এ ব্যানার নিয়ে কাজ না করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ প্ল্যাটফর্মের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্বে যাওয়ার পরই টের পাই সংস্কার, জুলাই, শহীদ, আহত এসব মুখের বুলিমাত্র। শুধু আমি না, অনেক ছাত্রই পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। সবার সঙ্গে শুধু ছলনা হয়েছে। যারা আমাকে কষ্ট দিয়েছে, আমার সঙ্গে নোংরামি করেছে এতগুলো মাস, অভ্যুত্থানকে বাজারদরে কেনাবেচা করেছে, তাদের আমি কখনো ক্ষমা করব না।’ তাঁর এ বক্তব্য বিপ্লবীদের প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত করেছে। মব ফ্যাসিজমেও বিপ্লবীদের নাম যুক্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিপ্লবীরা আবার কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছেন। আরও কত কী যে হচ্ছে, তা বলা মুশকিল।
বিপ্লবের পর দেশের সব অংশীজনের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ততই অনৈক্য আরও প্রকট হচ্ছে। এ অনৈক্যের বিষয়টি মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সম্প্রতি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ শেখ হাসিনাকে সরাতে ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন কী ধরনের সরকার তারা চায়, সে বিষয়ে ঐক্য নেই। প্রত্যেকে চায় তার নিজের মতামতই দেশের সবাই মেনে নিক। আর তাতেই সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এখন সেই লোকজনের মধ্যেই দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে, যারা কদিন আগেই ঐক্যবদ্ধ ছিল।’ লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়ের কথা বলা হয়েছে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে নির্বাচন হতে পারে বলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্মত হয়েছেন। এর আগে নির্বাচন নিয়ে সবার মধ্যে যে ধোঁয়াশা কাজ করছিল, লন্ডন বৈঠকের পর তা কেটে যায়। কিন্তু সৃষ্টি হয়েছে নতুন সংকট। এখন পর্যন্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। সবার ঐক্যের পরিপ্রেক্ষিতে এ মাসে জুলাই সনদ হওয়ার কথা। এখন পর্যন্ত ঐকমত্য কমিশন যে পর্যায়ে আছে, তাতে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কোনো ইস্যুতে ন্যূনতম ঐক্য হবে বলে মনে হচ্ছে না। বিপ্লবের সুযোগ নিয়ে সব দল এখন ক্ষমতায় যেতে চায়। আমাদের দেশে যেসব রাজনৈতিক দল আছে এবং বর্তমান উর্বর সময়ে যেসব দলের জন্ম হচ্ছে, সেগুলোর অবস্থা কমবেশি সবাই জানে। আগামী নির্বাচনে এসব দল যদি কোনো জোটবদ্ধ না হয়ে এককভাবে নির্বাচন করে, তাহলে কার কত দৌড় বোঝা যাবে। বিএনপি ছাড়া অন্য সব দলই অনুধাবন করতে পারছে, এককভাবে এবং বর্তমান প্রত্যক্ষ ভোটের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে ক্ষমতার ধারেকাছেও তারা থাকতে পারবে না। সে কারণেই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নতুন বন্দোবস্ত চায়। যে বন্দোবস্ত তাদের ক্ষমতাসীন করবে। জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার গালভরা বুলি আওড়ালেও লক্ষ্য হলো জনগণকে ফাঁকি দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া। সেজন্যই সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থার ফাঁকফোকর দিয়ে ক্ষমতার অংশীদার হতে চায়। ক্ষমতালোভীদের নতুন বন্দোবস্তের দাবি শুধু যে ক্ষমতা তা নয়, তাদের অন্যতম লক্ষ্য বিএনপিকে ঠেকানো। বিএনপি যাতে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে না পারে, স্বাধীনতার ঘোষক জিয়ার উত্তরসূরি তারেক রহমান যাতে সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব গ্রহণ করতে না পারেন। কারণ তারা জানেন স্বাধীনতার ঘোষক জিয়ার উত্তরসূরি রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আপসহীন থাকবেন। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, তাদের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা কোনো সুখকর বার্তা নয়। স্বাধীনতার ঘোষকের প্রতিও তাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকবে-এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
বিএনপির সামনে এখন একটি মাত্র পথ, তা হলো-দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শতভাগ আপসহীন থাকা। স্বাধীনতা যাদের কাম্য ছিল না, স্বাধীনতার ঘোষকও তাদের পছন্দের কেউ না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার একমাত্র সোল এজেন্ট দাবিদার আওয়ামী লীগ যেমন মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা ও মেজর জিয়াকে গ্রহণ করতে পারেনি, তেমন স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীরাও গ্রহণ করতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং এ বাস্তবতা অনুধাবন করে বিএনপিকে সব অপশক্তি কৌশলে মোকাবিলা করতে হবে। নতুন বন্দোবস্তের নামে মতলববাজি ঠেকাতে হবে। বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশকে জিয়াউর রহমানের আদর্শে গড়ে তুলতে হবে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন