কুড়িয়ে পাওয়া মোবাইল নেড়েচেড়ে দেখে ফাতেমা। হারুন দৌড়ে আসে। আনন্দে আত্মহারা হয়, কাগজের বস্তা মাথা থেকে নামিয়ে জিজ্ঞাসা করে
: কই পাইলি বু, দেখি, খুব সুন্দর তাই না?
: খড়ি কুড়াচ্ছিলাম, স্টেশনে পাইছি। আশপাশে কেউ ছিল না। এগোয় গিয়া জিজ্ঞাসা করলাম, কারও কিছু হারাইছে? সবাই কইলো ‘না।’
: নতুন। ম্যালা দাম। কত দাম হবে? দশ হাজার?
: দাম দিয়া আমি কি করুম। আমার জিনিস না কি!
: তুই পাইছস, এইটা তর। চল্ মুসা ভাইয়ের কাছে। সে পুরান মাল কেনে।
: চুপ! এক্কেবারে চুপ থাকবি। এইটা যার জিনিস তারে দিমু, বুঝলি।
পরের মাল নিতে হয় না ভাই।
: আরে পরের মাল কি? এইটা অহন আমাগো। বিক্রি করে ঝালমুড়ি আর শরবতের দোকান দিমু। টাকায় টাকা।
: তোর মাথায় পোকা ঢুকছে, টাকার পোকা। চল্ বাড়ি চল্।
মন খারাপ হয়ে যায় হারুনের। ফতে বু ক্যান যে বুঝল না। হঠাৎ খুশি মুখটা অন্ধকার হয়ে যায়। বস্তির ছোট্ট ঘরে ফিরে এসেও চুপচাপ থাকে হারুন। একটু বাদে রেলস্টেশনে গিয়ে বসে থাকে। রাশু ভাই হাত নেড়ে ডাক দেয়। রাশু ভাই রাজনীতি করে, সবাই তারে ডরায়। আস্তে আস্তে ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় হারুন।
: ফতে কি নাকি পাইছে? আমরা খবর পাই না ক্যান? শোন্ যা-ই পাক সমস্যা নাই। ফতেরে দেখা করতে কইবি। যা ভাগ।
হারুন মাথা নিচু করে থেকে চলে আসে মতির চায়ের দোকানে। বাকিতে পাউরুটি চা খায়। কিছু ভাল্লাগে না। ঘরে ফিরে যায়। ফতে বু বলে
: জানিস হারুন, ফোনে কল আইছিল। ময়নার মারে দিয়া ধরাইছিলাম, এইটা একটা স্যারের ফোন। নাম হাসান। রবিবারে আইবো কইছে। আমিও কথা কইছি। আর চার্জ নাই।
: রাশু ভাই দেখা করতে কইছে।
: তুই কিছু কইছস ভাই?
: না। মনে হয় স্টেশনের কারও কাছে শুনছে।
ফতেমার মন খারাপ হয়ে যায়। রাশু গুন্ডার কানে যাওয়া মানে ব্যাপারটা অনেক দূর গড়াবে। লোকটা একটা শয়তানের শয়তান। ফকিরের কাছ থেকেও চাঁদা নেয়। মনে ভয় নিয়ে সন্ধ্যার পর শুয়ে পড়ে দুই ভাইবোন। রাত ১০টায় মোটরসাইকেলের শব্দে ঘুম ভাঙে ফতেমা ও হারুনের। তারপর দরজায় টোকা। দরজা খোলে না কেউ। ময়নার মায়ের সঙ্গে কথা বলে ফিরে যায় রাশু। কাল রবিবার। ফোনটা হাসান স্যারের হাতে না দেওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই। কখন যে আসবে মানুষটা! হারুন বুবুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে-
: বুবুরে আমার খুব ডর করতাছে। কিচ্ছু হইবে না তো?
রবিবার। সকাল সকাল একগাদা লোকজন নিয়ে হাজির হয় রাশু। ফতে বুর চুলের মুঠো ধরে কিলঘুসি লাগায়। বলে : কোথায় রেখেছিস আমার মোবাইল? বের কর। কালো রঙের মোবাইল।
হারুন দৌড়ে আসে। কিন্তু অসুরের মতন শক্তি নিয়ে তাকে ছুড়ে ফেলে দেয় রাশু। সবাই বলে ওঠে : রাশুর মোবাইল ফেরত দে। নইলে অবস্থা আরও ভয়ানক হবে। কিন্তু ফোন বের করে না ফতেমা।
হঠাৎ ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসেন এক ভদ্রলোক। ফতেমাকে মাটি থেকে তুলে বলেন
: তুমি ফতেমা?
: হ।
রাশু বলে : কে আপনি?
: পরে বলছি। ফতেমা আপনার ফোন চুরি করেছে তাই তো?
: হ্যাঁ, কালো রঙের মোবাইল।
: কোন কোম্পানির?
: না, মানে... ইয়ে...
: ইয়ে.. মানে.. ফোনটা আপনার না।
: আপনি কে?
: আমি হাসান। এসআই। আমি না বলা পর্যন্ত আপনি যাবেন না।
ফাতেমা দৌড়ে এসে ফোনটা হাসান সাহেবের হাতে তুলে দিল। হাসান সাহেব বললেন
: তুমি তো ফোনটা বিক্রি করে দিতে পারতে। এদের এত অত্যাচার সয়েও ফোনটা হাতছাড়া করোনি। আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে কী পেলে?
কপালের রক্ত মুছে ফতেমার ছোট্ট উত্তর : শান্তি।