দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন আবার অস্থির হয়ে উঠেছে। নির্বাচনের আগে চার দফা দাবিতে কয়েকটি দলের যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা ও রাজনৈতিক সহিংসতার আশঙ্কায় উৎকণ্ঠায় রয়েছেন ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা। নতুন বিনিয়োগে খরা এবং অর্থনৈতিক সূচকের নিম্নমুখী প্রবণতায় থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই রাজনৈতিক অস্থিরতা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অর্থায়ন সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং রাজস্ব আদায়ের ধীরগতি-সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি এখন এক বহুমুখী সংকটে পড়েছে। সম্ভাবনাময় অনেক শিল্প-কারখানা যেমন অর্থাভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না, তেমনি বহু প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে না। এমন সময় এই রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে।
দেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করে তাঁরা বলছেন, প্রতিটি নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তরকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরম আকার ধারণ করে, যা ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অতীতে নির্বাচনকালীন জ্বালাও-পোড়াও এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেশের অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, এই সময় দেশের শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছিল।
নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক বলেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়। অনেক নির্বাচনই দেখেছি, নির্বাচনের সময় এবং নির্বাচন-পরবর্তী ক্ষমতা হস্তান্তর খুব শান্তিপূর্ণভাবে হয়নি। এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। কারণ গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ী হিসেবে আশা করব, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এই কাজটি সফলভাবে করতে পারবে বলে আমরা আশা রাখতে চাই। কিন্তু আমরা শঙ্কিত, আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক কিছু দাবি নিয়ে যে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তা উদ্বেগজনক। খোদ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাই যদি উদ্বিগ্ন হন, তাহলে আমাদের উদ্বেগ আরো বেড়ে যায়।
এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আশা করব, তারা যার যার জায়গা থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ঠিক রাখতে দায়িত্বশীল ও সহনশীল আচরণ করবে। শুধু নির্বাচন নয়, সব দিনই আমরা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে পারি এবং নির্বাচনের পরও যাতে এটি অব্যাহত থাকে, সে পর্যন্ত কোনো মারামারি-হানাহানি যাতে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে না পারে, সে ব্যাপারে আমাদের সবার সজাগ থাকতে হবে।
দেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলোর বেশির ভাগই এখন নিম্নমুখী। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি তলানিতে, যা নতুন বিনিয়োগের স্থবিরতাকে স্পষ্ট করে। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতেও ধস নেমেছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে দেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরিবেশে এক ধরনের স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। একদিকে যেমন অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, অন্যদিকে সম্ভাবনাময় অনেক নতুন উদ্যোগ অর্থের অভাবে আটকে আছে। ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে সতর্ক হয়ে উঠেছে। কারণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে গেছে।
মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমানো সম্ভব হলেও তা এখনো সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। বিবিএসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৮ শতাংশের বেশি হলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে, যা গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছে।
দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট এবং উচ্চ সুদহারের কারণে ব্যবসায়ীরা নতুন করে অর্থায়ন পেতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি সুদহার বাড়ালেও এর প্রভাব সরাসরি পড়েছে ঋণের ওপর। অনেক ব্যাংক এখন ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদে ঋণ দিচ্ছে, যা উৎপাদনশীল খাতের জন্য এক বড় বোঝা।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য : ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও পেশাজীবীরা একমত, ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল এবং ব্যবসা-বিনিয়োগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে একটি নির্বাচিত সরকার জরুরি।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। নির্বাচন সম্ভবত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের একমাত্র উপায়। সামষ্টিক অর্থনীতি, জ্বালানি এবং দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মতো জরুরি বিষয়গুলো মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রয়াস ছাড়া সমাধান করা যায় না। রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল সরকারের প্রয়োজন এ কারণেই।’
বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত দেশে বিনিয়োগে স্বস্তি ফিরবে না। অন্তত নির্বাচনের তারিখ জানা থাকলেও উদ্যোক্তাদের জন্য কিছুটা সুবিধা হয়। নির্বাচনের তারিখ জানা না থাকলে অনেক উদ্যোক্তা বিনিয়োগ করবেন না।’
আস্থার ঘাটতি ও ভবিষ্যতের প্রত্যাশা : বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমান সরকারের কাছে সবার অনেক আশা ছিল। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও শিল্পের জ্বালানিতে উন্নতি হয়নি। বরং বেসরকারি খাতের ব্যবসায় সরকারের নজর কম। এ কারণে ব্যবসায়ীরা ভুগছেন। বেসরকারি খাতে আস্থার ঘাটতি থাকায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে দেশও পিছিয়ে আছে। নির্বাচনের ঘোষণায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। এ জন্য যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা দরকার।’
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক সচিব মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি দীর্ঘদিন বিনিয়োগকারীদের দ্বিধায় ফেলেছিল এবং বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। তবে নির্বাচন ঘোষণার ফলে সেই অনিশ্চয়তা কিছুটা কেটেছে। বিশ্ব অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে-এ সময় দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ধরে রাখা জরুরি। ব্যবসায়ীসমাজ সব সময় চায়, একটি নির্বাচিত সরকার স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও স্থিতিশীলতার মাধ্যমে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিক। তাই এফবিসিসিআই মনে করে, এই নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারেরও সুযোগ। অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ব্যবসাবান্ধব পরিবেশকে সুসংহত করবে।’
অর্থনীতিবিদদের আহবান : দায়িত্বশীলতা জরুরি
অর্থনীতিবিদরা আশা করছেন, রাজনৈতিক দলগুলো দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এবং অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে এমন কোনো কর্মসূচি দেবে না, যা জনজীবনকে জিম্মি করবে বা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি করবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, রাজনৈতিক মতপার্থক্য বা অনিশ্চয়তা সহজেই আন্দোলন, অবরোধ কিংবা সংঘাতের দিকে গড়াতে পারে। বিশেষ করে যদি অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্য স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে আস্থা ও সমঝোতা গড়ে না ওঠে, তবে উত্তেজনা বাড়তে পাড়ে। এ ছাড়া তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা, অর্থনৈতিক চাপ ও সামাজিক গণমাধ্যমের দ্রুত প্রভাব অনেক সময় হঠাৎ করেই অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। রাজনৈতিক অস্থিরতা সবচেয়ে আগে প্রভাব ফেলে আস্থার ওপর। বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে ভয় পান। এর ফলে স্থানীয় বিনিয়োগ ও বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘এখন সময় এসেছে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল হওয়ার। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় সরকারের যেমন ভূমিকা আছে, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা রয়েছে। যদি তারা কেবল নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে সংঘাতের পথে হাঁটে, তাহলে তার মূল্য দিতে হবে দেশের সাধারণ মানুষকে। আমার প্রধান প্রত্যাশা হলো সমঝোতা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, কর্মসংস্থান ও আস্থা। অর্থনীতি ও ব্যবসার স্বার্থে প্রত্যাশা হলো রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকলেও সেটি যেন সহনশীলতার ভেতরে থাকে এবং নীতি প্রণয়ন যেন দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে হয়।’
সূত্র : কালের কণ্ঠ
বিডি প্রতিদিন/এমআই
 
                         
                                     
                                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        