স্বামী প্রবাসী। ভালোই আয় করে। দুই সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই কাটছিল ছন্দার (ছদ্মনাম)। প্রতিদিনই স্বামীর সঙ্গে ভিডিও কলে কথা হয়। স্বামী টাকা পাঠান খরচের চেয়েও বেশি বেশি। সেই টাকায় বাসা ভাড়া, দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ মিটিয়ে আবার কিছু জমাতেও থাকে। সব মিলিয়ে বাঙালি সমাজের এক আদর্শ পরিবার। কিন্তু বছরখানেক যেতে না যেতেই সংসারে নেমে আসে এক অমানিশার অন্ধকার। তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি সেই সোনার সংসার তাসের ঘর হয়ে যায়। প্রবাসী স্বামী স্ত্রীর বাচন ভঙ্গিতে ব্যাপক পরিবর্তন বুঝতে পারে। ফোন দিলেও ধরে না। আবার ধরলেও টুকটাক কথা বলে ফোন রেখে দেয়। স্বামী বুঝতে পারে, কোথাও কোনো সমস্যা হচ্ছে। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে নানা ঝামেলার কথা শোনায়। এভাবেই কেটে যায় বছর দুই। বিদেশ বসেই স্বামী জানতে পারে তার স্ত্রী আর আগের মতো নেই। পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছে। অবশেষে প্রাণের টানে স্বামী তার দেশে ফিরে আসে। জানতে পারে তার স্ত্রীর সব কর্মকা-। তবে এতদিনে সব শেষ। স্ত্রীরও আর বুঝতে বাকি থাকে না এতদিন সে মরীচিকার পেছনে ছুটেছে। ভ- প্রেমিকের প্রেমে সে ছিল মত্ত। কিন্তু ততদিনে সব শেষ তার। বিদেশ থেকে স্বামীর পাঠানো টাকা, জমানো সব সঞ্চয়-অন্তত ১০ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিল গোপন প্রেমিকের হাতে। সেই গোপন প্রেমিকের আসল চেহারা যখন সে দেখে ফেলে ততদিনে তার স্বামীও তাকে ছেড়ে চলে গেছে। ছন্দা এখন সব হারিয়ে পথে বসেছে। গোপন প্রেমিক-প্রেমিকার দ্বন্দ্ব থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে তাদের নিষিদ্ধ প্রেমের কাহিনী। তদন্তে জানা যায়, ঘটনাটির সূত্রপাত ২০১৬ সালের ১৫ জানুয়ারি। ছন্দা (ছদ্মনাম) নামের ওই নারী একটি ফ্ল্যাট খুঁজছিলেন। বাড়ি খোঁজার সূত্র ধরে জনৈক এক দারোয়ানের সঙ্গে পরিচয় হয়। দারোয়ানের মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত ওই নারী মাসিক ১৩ হাজার টাকায় তিন রুমের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। বাসায় স্বামী ও দুই সন্তানের থাকার কথা। ওই বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে ওই নারী বসবাস শুরু করেন। দারোয়ানের মাধ্যমে প্রেমিকের সঙ্গে পরিচয় হয় ওই নারীর। ঘটনার সময় ওই নারীর স্বামী বিদেশ ছিলেন। স্বামী না থাকায় নিজে দুই রুম রেখে এক রুম ব্যাচেলর হিসেবে ভাড়া দেন। যদিও বিষয়টি তিনি বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়া অন্য ব্যাচেলরদের জানাননি। প্রেমিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। ঘনিষ্ঠতা থেকে দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রেম থেকে তারা অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। ওই নারীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তারা স্বামী-স্ত্রীর মতো ওই বাসায় বসবাস করতে থাকে। অবৈধ সম্পর্কের নানা ছবিও ভিডিও করে রাখে ওই ভ- প্রেমিক। প্রেমিক একদিন ওই নারীকে বলে, নতুন বাসা ভাড়া করা হয়েছে। নতুন বাসার ভাড়া ও ফার্নিচারসহ অন্য মালামাল কেনার জন্য ৬০ হাজার টাকা দরকার। এরপর প্রেমিক অত্যন্ত কৌশলে ওই নারীর স্বর্ণালঙ্কারগুলো গোপনে নতুন ভাড়া বাসায় রাখার কথা বলে। প্রেমিক বলে, আগে আগে নিয়ে না রাখলে শেষ দিকে নেওয়ার সময় কেউ সন্দেহ করলে চোর-ডাকাত পিছু নিতে পারে। এমন কথায় বিশ্বাস করে ছন্দা তার আট ভরি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার প্রেমিককে দেয়। প্রেমিক সেগুলো নিয়ে বাসায় রাখার কথা বলে বের হয়। এরপর থেকেই প্রেমিক ওই পুরুষের আর হদিস নেই। উপরের এ গল্পটি বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ চাউর হয়ে উঠে।
পরকীয়া ফৌজদারি অপরাধ নয়। ইংরেজ শাসনকালে তৈরি এই আইনের ৪৯৭ ধারা অসাংবিধানিক। এমনটিই রায় দিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, এই আইন স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। মহিলাদের স্বাতন্ত্র্য খর্ব করে। স্বামী কখনই স্ত্রীর প্রভু বা মালিক হতে পারেন না। ভারতে ১৮৬০ সালে তৈরি ওই আইনের ৪৯৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করলে এবং ওই মহিলার স্বামীর অনুমতি না থাকলে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে। বিবাহিত নারীকে ‘অপরাধের শিকার’ বিবেচনা করে আইনে সম্পর্ক স্থাপনকারী পুরুষকেই দোষী হিসেবে গণ্য করার বিধান ছিল। এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেন যোশেফ শাইন। পরকীয়া অপরাধ নয় জানিয়ে এ সংক্রান্ত দেড়শ বছরের পুরনো একটি আইন বাতিল করে দিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। পরকীয়ার সাজা সংক্রান্ত বাংলাদেশ দ-বিধির ৪৯৭ ধারা কেন অবৈধ এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাই কোর্ট। ৮ জুলাই ২০১৯ বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি ইকবাল কবিরের হাই কোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করে। এর আগে গত ১১ ফেব্রুয়ারি অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান এ রিটটি দায়ের করেন। রিটে ৪৯৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশনার আবেদনও রয়েছে। দ-বিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী কোনো স্ত্রী পরকীয়া করলে যার সঙ্গে পরকীয়া করবে শুধু সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রয়েছে। অথচ স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামীর কিছুই করার নেই। একইভাবে স্বামী পরকীয়া করলে স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে বা যার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িত হবে তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকার পাবেন না। উপরন্তু স্বামী যদি কোনো বিধবা বা অবিবাহিত নারীর সঙ্গে পরকীয়া জড়িয়ে পড়েন এবং স্ত্রী যদি স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে পরকীয়ায় জড়িত হয় তা আইনত বৈধ। এই আইন সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ৩২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং এটা অদ্ভুত ও বৈষম্যমূলক।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।