গত শতাব্দীর আশির দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা। সেই থেকে কৃষি ও কৃষক, ফসল, সবজি ও ফল-ফলারি চাষ থেকে শুরু করে হাঁস-মুরগি লালনপালন, মাছ চাষ, গবাদি পশু লালনপালন ইত্যাদির খবরাখবর নিয়ে পথচলা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে চলেছি। এমনকি দেশ-বিদেশের কৃষিবিষয়ক নানান তথ্য-উপাত্ত, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিজ্ঞানীদের ভাবনাচিন্তা, গবেষণা সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন জলবায়ু আর ভিন্নরকম ফলফসলের চিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে চেষ্টা করেছি আমাদের দেশের কৃষিবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ করার। এমনই এক সফরে সম্ভবত ২০০৬ সালের দিকে গিয়েছিলাম জাপানে সেখানকার কৃষি নিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে। সে সময় চ্যানেল আইয়ের জাপান প্রতিনিধি ছিলেন জানে আলম জনি। তিনি দীর্ঘদিন জাপানে বসবাস করছিলেন। জিনজার হাটসুবুরিতে ছিল তার বাসা। সেখানে তার প্রতিষ্ঠিত একটি রেস্টুরেন্ট ছিল, খারে খাকুমে। তার বাসা থেকে এক সকালে রওনা হয়েছিলাম নাসের দিকে। সেখানে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্গানিক ও প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি বিষয়ে তাদের কর্মকান্ড গবেষণা ইত্যাদি বিষয়ে জানতে। চলতি পথে টোকিওর উয়েনে আমেইকো নামের এক পাইকারি ফলের বাজারের কাছে যাত্রাবিরতি দিলাম। আমি ক্যামেরায় বাজারের চিত্র ধারণ করছিলাম। হঠাৎ কানে এলো ‘রাজশাহী-রাজশাহী’ বলে কেউ ডাকছেন। বিস্মিত হলাম। দেখি এক ফল বিক্রেতা এমনভাবে ডাকছেন। তার দোকান দেখে মনে হলো নানান জাতের আমের ভান্ডার। আমি ভাবলাম সেখানে বোধহয় রাজশাহীর আম আছে। আমি জনির কাছে জানতে চাইলাম ঘটনা কী? ওই লোক কি রাজশাহীর আম বিক্রি করছেন? জনি হেসে জানাল, না স্যার। ও রাজশাহী বলে ডাকছে না। ও বলছে ‘ইরাজশাই’। জাপানে যখন কাস্টমারদের ডাকে তখন এ বলেই ডাকে। বাঙালি হিসেবে ইরাজশাইকে ভেবেছিলাম ‘রাজশাহী’, দোকানে প্রচুর আম দেখে দ্ধন্ধটা আরও ঘন হয়েছিল। কত রকম আর কত রঙের আমের যে পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন! সেখানে লাল রঙের অনেক আম দেখেছি। সেগুলো মেক্সিকান পালমার না মিয়াজাকি, বলতে পারব না। যদি মিয়াজাকি হয় তবে সে সময়ই প্রথম মিয়াজাকি আম দেখে থাকব। যাই হোক, মিয়াজাকির বিষয়ে পরে আসছি। বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের তুলনা হয় না। তাদের সফলতার ধারাবাহিকতায় রচিত হয়েছে আমাদের খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের পথ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যেখানে আমাদের লোকসংখ্যা ছিল ৭ কোটি, আজ সেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি (সরকারি তথ্যমতে)। ক্রমেই কমেছে কৃষিজমির পরিমাণ। তার পরও এ বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে এ দেশের কৃষিবিজ্ঞানী, গবেষক, কৃষক, সম্প্রসারণকর্মী, সর্বোপরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও গণমাধ্যমের লাগাতার উন্নয়ন সম্প্রচারের কল্যাণে। এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে উচ্চফলনশীল ধানের জাত উন্নয়ন। এরপর তরুণদের মাঝে মাছ চাষ ও হাঁস-মুরগি পালনের জোয়ার কৃষি সমৃদ্ধির পথকে করেছে গতিশীল। দিন দিন বেড়েছে কৃষিবৈচিত্র্য। ফুল থেকে শুরু করে নানান বিদেশি সবজি ও ফলের চাষ বেড়েছে। দেশজুড়ে বছর ধরে হচ্ছে নানান ফলের চাষ। হরেক জাতের কুল, পেয়ারা, মাল্টা, কমলা, লেবু, স্ট্রবেরি, অ্যাভোকাডে, ত্বিন, আপেল, ড্রাগনসহ দেশি-বিদেশি ফলের চাহিদার সঙ্গে বেড়েছে চাষও। স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে পাল্টে যাওয়া কৃষি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমি পেয়েছি। ইতিহাস বলে, আম সব সময়ই পেয়ে এসেছে রাজকীয় গুরুত্ব। রাজপরিবারে আমের কদরের শেষ ছিল না। ফলে সুমিষ্ট আম সাধারণ মানুষ কমই পেত। সুমিষ্ট আম ছিল কোহিনুরের মতো দামি ও সম্মানী। অনুমান করা হয়, আমের পরিকল্পিত চাষের চর্চা শুরু করেন প্রথমে সম্রাট আকবর। ১৫৭০ থেকে ১৫৮০ সালের মধ্যে মোগল সম্রাট আকবর গোটা ভারতবর্ষ থেকে সংগ্রহ করে এনে বর্তমান বিহারের দ্বারভাঙায় রোপণ করেছিলেন বিভিন্ন প্রজাতির ১ লাখ আমের চারা। সে বাগানের নাম ‘লক্ষবাগ’। আমের রাজকাহন অনেক দীর্ঘ। একসময় গবেষকরা ভারতীয় উপমহাদেশে আমের ১ হাজার ৬৫০টি জাতের একটা তালিকা তৈরি করেছিলেন। এখন অনেক জাতই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বছর কয়েক আগে ঢাকায় জাতীয় ফল প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছিল ৭৫ জাতের আম। আমের জাতের নামেও রাজকীয় চিহ্ন লেগে আছে। ক্ষীরভোগ, মোহনভোগ, রাজভোগ, রানীভোগ, রানীপছন্দ, সিন্দুরা, সুবর্ণরেখা, জগন্মোহিনী, ক্ষীরমন, দুধসর, বেগমবাহার, পূজারিভোগ, রাজলক্ষী, দুধকুমারী, বাদশাহ-পছন্দ, বেগমপছন্দ, রাজাপছন্দ, বনখাসা, কোহিতুর- কত শত নাম!
আমাদের দেশে আমের রাজধানী হচ্ছে বৃহত্তর রাজশাহী। বলা চলে ওই অঞ্চলই মূলত সুমিষ্ট আমের একচ্ছত্র অধিকারী। মনে পড়ে সেই আশির দশক থেকে বাংলাদেশে ফলের চাষ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে অনেক প্রথিতযশা বিজ্ঞানীর সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হয়। ড. আমজাদ ছিলেন তাদের একজন। সে সময় তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সুমিষ্ট আম কেন শুধু রাজশাহীতেই হয়? কেন সারা দেশেই আমের চাষ সম্ভব হচ্ছে না? তিনি জানিয়েছিলেন আম চাষে মাটি ও জলবায়ুর সীমাবদ্ধতা। কিন্তু গবেষকরা ক্রমেই সেই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করেছেন। আমরা এখন জানি, সুমিষ্ট আম্রপালি সারা দেশেই চাষ করা সম্ভব। টাঙ্গাইল, নরসিংদী, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জসহ সারা দেশেই তরুণ উদ্যোক্তারা এ আম চাষ করে সফল হয়েছেন। আম্রপালি বদলে দিয়েছে আমাদের দেশে সুমিষ্ট আমের ইতিহাস। ১৯৭৮ সালে ভারতের আম গবেষকরা দশহোরি ও নিলাম- এ দুটি আমের মধ্যে সংকরায়ণের মাধ্যমে আম্রপালি আমের জাত উদ্ভাবন করেন। ১৯৯০ সালে প্রথম আমাদের দেশে আম্রপালির চারা আসে। এ দেশের আবহাওয়ার কারণে উন্নত জাতের আম এক গাছে এক বছর ফলে, পরের বছর ফলে না। কিন্তু আম্রপালি প্রতি বছর ফলে। এর মিষ্টতার পরিমাণ ল্যাংড়া বা হিমসাগরের চেয়ে বেশি। গাছের আকার ছোট। কিন্তু ফলন বেশি। ৫ হাত দূরত্বে ১ হেক্টর জমিতে ১ হাজার ৫০০ আম্রপালির চারা রোপণ করা যায়। প্রতি হেক্টরে ১৬ মেট্রিক টন আম্রপালি ফলে।
আমের রাজ্যে প্রতিনিয়তই যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন জাত, নতুন নতুন নাম। দেশি গবেষকরা যেমন যুক্ত করছেন বারি-৪, বারি-১১ প্রভৃতি আমের জাত। তার চেয়েও বেশি যুক্ত হয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে বিদেশ থেকে আনা বিভিন্ন জাতের আম। বিশেষ করে দেশি নার্সারিগুলো বিভিন্ন জাতের আম থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে আমাদের দেশে পরিচিত করে তুলেছে। আমের নাম মিয়াজাকি। আমের জগতের নতুন মিয়া। মিয়াজাকি আম আমাদের দেশে ‘সূর্য ডিম’ নামে পরিচিতি পাচ্ছে। আগুনে লাল রঙের দৃষ্টিনন্দন এ আমের জাপানি নাম ‘তাইয়ে নো তামাগো’। জাপানি ভাষার এ শব্দগুচ্ছের অর্থ ‘এগ অব দ্য সান’, অর্থাৎ সূর্যের ডিম। যতটুকু জেনেছি, ১৯৮৫-৮৬ সাল থেকে জাপানি আম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এমন লোভনীয় আম উৎপাদনের চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। কিন্তু কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত রং ও স্বাদ পাওয়া যাচ্ছিল না। আম বড় ও পুষ্ট হতে শুরু করলে এক ধরনের কালো স্পট আমের উজ্জ্বল রংটিকে নষ্ট করে দিত। সাত-আট বছর প্রচেষ্টার পর আমের রং ঠিকঠাক হলো ঠিকই, সমস্যা দেখা দিল স্বাদে। অনেক চেষ্টা-প্রচেষ্টার পর আবিষ্কার করা গেল এ আম পেকে নিজ থেকে গাছ থেকে ছিঁড়ে পড়লে সর্বোচ্চ স্বাদ মেলে। তাই এ আমের জন্য প্রয়োজন বোঁটা থেকে খসে পড়ার পর যেন গাছের সঙ্গেই ঝুলে থাকতে পারে সে রকম ব্যাগিং। একটা চমৎকার সিঁদুরে মিয়াজাকি আম ফলাতে প্রয়োজন সর্বোচ্চ যত্ন। মিয়াজাকি আম নেটদুনিয়ার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ২০১৭ সালে যখন জাপানের ফুকুওকা শহরের একটি ডিপার্টমেন্ট স্টোরে নিলামে এক জোড়া আমের দাম ওঠে ৫ লাখ জাপানি ইয়ান। অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় সাড়ে ৩ লাখ টাকার ওপরে। জাপানের দক্ষিণ-পুবে মিয়াজাকি এলাকায় প্রথম উৎপাদন হওয়ায় এটি মিয়াজাকি আম নামে পরিচিত। গ্রিনহাউসে অতিযতেœ চাষ করা মিয়াজাকিকেই এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে দামি আম বলা হয়। আমি এ আমের সন্ধান পাই আরও আগে, ছাদকৃষিতে, ঢাকায়। কিন্তু ফল না আসায় আমের জাত সম্পর্কে কিছুই বলা যাচ্ছিল না। জাপানের মিয়াজাকি ঢাকায় ফলবে কি না তা-ও ছিল সন্দেহে। কিন্তু সব সন্দেহ দূর করে দিয়ে ঢাকার জাফরাবাদের ব্যবসায়ী ও বৃক্ষপ্রেমী ওমর ফারুক ভূঁইয়া তার ছাদে বিস্ময়করভাবে ফলিয়েছেন মূল্যবান মিয়াজাকি আম। ওমর ফারুকের একটুকরো ছাদে ছোট ছোট গাছে ঝুলে আছে সিঁদুরে আমের থোকা। এ এক মুগ্ধকর দৃশ্য।চ্যানেল আইয়ের খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি আজহার হীরা জানিয়েছিলেন, সেখানকার মংসেতু চৌধুরী নামে এক তরুণ ও হ্লাশিমং চৌধুরী নামে কৃষক ব্যক্তি উদ্যোগে মিয়াজাকি আমের চাষ করছেন। শুনেছি এ বছর নাকি বেশ ফলন এসেছে তাদের রোপণকৃত গাছগুলোয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে কৃষক বাবুল ফোনে জানিয়েছেন, তিনি নতুন দুই জাতের আমের চাষ করেছেন। জানতে চাইলাম, নতুন দুই জাতের আমের নাম কী? জানালেন মিয়াজাকি ও বোম্বাই। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কৃষি অনুরাগী আকবর হোসেনও মিয়াজাকি আমের চাষ করছেন। তার বাগানে ৭০টি গাছ আছে। বছরব্যাপী ফল চাষের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ড. মেহেদি মাসুদ জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া মিয়াজাকি আম চাষের উপযোগী। সরকারি উদ্যোগেও সরকারি হর্টিকালচার সেন্টারগুলোয় এ আমের চারা উৎপাদনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। দেশের অগণিত বেসরকারি নার্সারিতে মিয়াজাকি আমের চারা তৈরি হচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, ইতিমধ্যে ছাদ থেকে জাকি মিয়া মাঠে নেমে গেছেন। যে কোনো কৃষিপণ্যের ভালো বাজার ধরতে হলে তাকে প্রথমে দেখতে সুন্দর হতে হয়, তারপর গুণেও হতে হয় অনন্য। পাশাপাশি বিশ্ববাজার দখল করতে আরও প্রয়োজন গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিসেস (গ্যাপ) সনদ। এ তিন বিচারে আমের বাজারে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে মিয়াজাকি। অনেক উদ্যোক্তাই যে কোনো নতুন ফলফসলের খবরে তাড়াহুড়া করে না বুঝেই বিনিয়োগ করে ফেলেন। ফলে কাক্সিক্ষত ফলন পান না। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের আগে যেমন লাভ-লোকসানের হিসাব-নিকাশের প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান আহরণ। বিশ্ববাজার দখলে সরকারি উদ্যোগ আর জেনে-বুঝে মিয়াজাকি আম চাষ করা গেলে আমি এ আমের সুন্দর ভবিষ্যৎ দেখছি।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।