সোমবার, ১১ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

দুর্গাপূজার অনুভূতি

ফনিন্দ্র সরকার

দুর্গাপূজার অনুভূতি

সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি বড় উৎসব দুর্গাপূজা। তবে বাঙালি হিন্দুদের কাছে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। এ উৎসবকে ঘিরে হৃদয়ে স্পন্দন সৃষ্টি হয়, অনুভূত হয় অনাবিল আনন্দ ও উন্মাদনা। ব্যাপক আবেগে পূজা অনুষ্ঠানের গাম্ভীর্য অনেক সময় রক্ষিত হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় সাজগোজ ও বাহ্য আড়ম্বর। আনন্দের প্রতিযোগিতা হয় পূজাকে কেন্দ্র করে। এতে মানুষকে আকর্ষণ করে ঠিক, কিন্তু ভক্তির ভাবে কিছুটা ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। আমরা সবাই বিশ্বাস করি, আনন্দের অভাব যেখানে সেখানেই বেদনা। কিন্তু মাতৃবন্দনার উৎসবানন্দ রূপান্তরিত হবে পরমানন্দে; সব বেদনার পরিসমাপ্তি এখানে। মাতৃপূজায় ভক্তের শ্রদ্ধা ও বিনম্রতার অর্ঘ্য সাজাতে হবে। যার পূজায় আমরা মেতে উঠেছি তিনি আমাদের এমন মা তা অনুভব করতে পারলে মায়ের পূজা-অনুষ্ঠান আরও আকর্ষণীয় হবে, সার্থক হবে। দুর্গাদেবী শক্তিরূপিনী, রাজ রাজেশ্বরী। তিনি বিশ্বালয়ের অধিকারী। তারই ইচ্ছাতে সৃষ্টি-স্থিতি প্রলয় কার্য সাধিত হচ্ছে। তিনি সাধুজনের রক্ষাকর্ত্রী দুষ্টের বিনাশকারিণী। তিনি সবার আশ্রয়দাত্রী। বেদে পুরাণে নানাভাবে তাঁর বন্দনা করা হয়েছে। হিন্দু শাস্ত্রে মহাশক্তির বিচিত্র প্রকাশের কথা বর্ণিত হয়েছে। একেকটি রূপকল্পের একেক রকম বৈশিষ্ট্য, এতে সাধনার পথে ভিন্নতা দেখা যায় বটে কিন্তু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন, তা হচ্ছে মহাশক্তির বন্দনা। কল্পান্তে ভগবান বিষ্ণু যোগনিদ্রায় অভিভূত। তাঁর নাভিপদ্ম থেকে জাত প্রজাপতি ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রতীক্ষায় ব্যাকুল। সহসা বিষ্ণুর কর্ণমূল থেকে উত্থিত মধু-কৈটভ দানবদ্বয় ব্রহ্মাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়। সৃষ্টি কার্য যেন ব্যাহত। এরূপ অবস্থায় ব্রহ্মা নিরুপায় হয়ে ভগবান বিষ্ণুর যোগনিদ্রা ভঙ্গে তৎপর হয়ে উপলব্ধি করলেন- যোগনিদ্রারূপিনী দেবীর মায়ায় ভগবান বিষ্ণু অচৈতন্য। এ নিদ্রা যোগমায়ারই খেলা। ব্রহ্মা এ দেবীর স্তবে নিবিষ্ট হলেন। দেবী ব্রহ্মার স্তবে তুষ্ট হলেন। তখন বিষ্ণুর নিদ্রা ভঙ্গ হলো। বিষ্ণু দেখলেন দুর্ধর্ষ অসুরদ্বয় আক্রমণোদ্যত। যুদ্ধ শুরু হলো দানব মধু-কৈটভ এবং বিষ্ণুর মধ্যে। এ যুদ্ধ চলে পঞ্চ সহস্রবর্ষব্যাপী। মদগর্বিত অসুরদ্বয়কে দেবী তাঁর মায়ায় আবিষ্ট করলেন। মোহিত হয়ে অসুরদ্বয় বিষ্ণুর কাছে বর প্রার্থনায় বাধ্য হয়, শেষ পর্যন্ত অসুরদ্বয় বিষ্ণু কর্তৃক নিহত হয়। দেবী এভাবে বিষ্ণুকে আশ্বস্ত করলেন এবং কাল নিদ্রায় অভিভূত করলেন মধু-কৈটভকে। এরপর দেবী কর্তৃক দূরাত্মা শক্তিশালী মহিষাসুর নিধন হয়। পরাক্রমশালী মহিষাসুরের অত্যাচারে দেবতারা স্বর্গরাজ্য হারিয়ে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্মা দেবতাদের নিয়ে বিষ্ণু ও মহেশ্বরের কাছে উপস্থিত হয়ে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মুখনিঃসৃত তেজোরাশি দিগন্তব্যাপী জ্বলন্ত পর্বতের আকার ধারণ করল। এ সংহত দেবশক্তি থেকে আবিভর্‚তা এক নারী মূর্তি। দেবতাগণ এ নারীমূর্তিকে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র প্রদান করে শক্তিশালী করেন। এ দেবী মূর্তি মহিষাসুর বধ করেন। পরবর্তীতে দেব শক্তিধর অসুরদ্বয় শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করে সব শক্তি বিভূতি পুনরায় সংহত করে নিজে একাকী বিরাজিত হলেন, তিনিই যে একমাত্র শক্তিময়ী দেবী তা প্রমাণ করলেন। দশ ভুজা এ নারীমূর্তিই দেবী দুর্গা। মর্ত্যে লীলাবিলাসের আকার হয়ে মনুষ্য সমাজে পুজিত হয় মহাশক্তির প্রতীক হিসেবে। পৌরাণিক কাহিনির আলোকে বর্ণিত কথাগুলোর মধ্যে একটি অনুভূতির বিকাশ ঘটে ভক্ত হৃদয়ে। পৌরাণিক কাহিনির বিভিন্ন পর্যায়ে অসুর নিধনের মধ্যে একটি বিশেষ তত্ত্ব নিহিত রয়েছে। মধু-কৈটভ পর্বে পরিলক্ষিত হচ্ছে অতর্কিতে আসুরিক তৎপরতা- এ হচ্ছে তামসিক অহংকার। মহিষাসুর বধ পর্বে উদঘাটিত- শুভবুদ্ধি যেন মূল্যহীন, এখানে পরাক্রমই সম্পদ- এ হচ্ছে রাজসিক অহংকার। শুম্ভ-নিশুম্ভ পর্বে আসুরিক বৃত্তি যুক্তি ও বুদ্ধির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এ ভাবটি অনেকটাই সংযত। এরা সাত্তি¡ক অহংকারের প্রতীক। এ তিন অবস্থা বা অশুভ বুদ্ধি আমাদের আবদ্ধ করে রেখেছে। দেবীর স্বরূপকে উপলব্ধি করতে আমাদের আসুরিক বৃত্তিকে সংযত করাই সাধনা। এটিই দুর্গাপূজার প্রতিপাদ্য বা তাত্তি¡ক দিক। দার্শনিক তত্ত্বে দেবী মাহাত্ম্য অনেক গভীর এবং ব্যাপক। ছোট পরিসরে এর বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তবে দেবী-ভাবনায় যে অনুভূতি সৃষ্টি হয় তার প্রমাণ হচ্ছে পূজানুষ্ঠানের ব্যাপকতায়।

দুর্গোৎসবকে শারদীয় উৎসবও বলা হয়। শরৎকালে এ পূজার প্রবর্তন ঘটে ভগবান রামের মাধ্যমে। আবার শারদোৎসবকে অকালবোধন হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। আবার রাবণ রাক্ষস তিনিও দেবীভক্ত হয়ে বসন্তকালে দেবী দুর্গার পূজা করেছেন। সেটিকে বাসন্তী পূজা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ সবই পৌরাণিক বিষয়। আমাদের অনুভূতির অণুষজ্ঞে দেবী কখনো অতি ভীষণা, আবার কখনো অতি সৌম্যা। ভীষণ মূর্তি তাঁর সংহারলীলার। আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে এ যেন তার সত্য সুন্দরের অভিযান। সৌম্যা মূর্তিতে তিনি আশ্রিত। ভক্তদের বরাভয়দায়িনী। দুর্গাপূজার অভীষ্ট ফলও দুই রকমের- ভক্তি ও মুক্তি। দেবীর ভীষণ মূর্তিতে শৌর্য, বীর্য, ঐশ্বর্যের বৈশিষ্ট্য। সুরথ রাজা, সমাধিবৈশ্য, রামচন্দ্র, অর্জুন, শিবাজী, রানা প্রতাপ সিং, শিখ গুরু গোবিন্দ সিং প্রভৃতি ভক্তগণ ভুক্তি অর্থাৎ ভোগ্য বিষয় লাভ করে ধন্য হয়েছেন। আবার রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, বামাক্ষ্যাপা প্রমুখ সাধকগণ দেবীর বরাভয় করা সৌম্যা মূর্তির আরাধনা করে প্রেম, ভক্তি, জ্ঞান, বৈরাগ্য কামনা করে মহামুক্তি লাভ করেছেন। এ সবই এক অর্থে অনুভূতির বিষয়। দেবী পূজার সংকল্প থেকে আরম্ভ করে দশমীর বিসর্জন পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী মহা ধুমধামে উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। দেবীপূজায় এক অপূর্ব প্রেরণা অনুভূত হয় ভক্ত হৃদয়ে। এ ভাবটি তেজোদীপ্ত। বর্তমানে পূজার বাহ্যড়ম্বার মাত্রাতিরিক্ত হওয়ায় প্রকৃত ভাবটি যেন দিনে দিনে ম্লান হয়ে পড়েছে। দুর্গাপূজার আরেকটি তাৎপর্য হচ্ছে সংহতি শক্তি। মূর্তি ভাবনা একটি সুন্দর ছবি দেদীপ্যমান- যেটা জাতি গঠনের সংহতি শক্তি। যে শক্তি পারস্পরিক ভালোবাসায় আবদ্ধ করতে সহায়তা করে মানব সমাজে। সব বিপদ নাশ করে দেবী দুর্গা তাঁর মহাশক্তির বলে পৃথিবীকে শান্তিময় করে তুলবে ভক্তদের এটাই প্রার্থনা। জয় মা দুর্গা।  

লেখক : কলাম লেখক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর