বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

আজও তাঁর বেদনার ধ্বনি শুনতে পাই

নূরে আলম সিদ্দিকী

আজও তাঁর বেদনার ধ্বনি শুনতে পাই

সত্যি বিচিত্র এ দেশ, বিচিত্র এ দেশের মানুষের মনন ও মানসিকতা। সীমাহীন আত্মত্যাগ ও অজস্র রক্তধারায় সিক্ত ঢাকার রাজপথ। ভিন্ন ভিন্ন দাবিতে ও ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এখানে মানুষের বুকনিঃসৃত রক্ত ঝরেছে অনেক। এর বিপরীতে প্রাপ্তিও কম নয়। স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণের অধিকার অর্জনের সফলতা ছাড়াও ১৯৭০-এর গণম্যান্ডেট ও তার ওপর ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগ ও চেতনায় সূর্যস্নাত আমাদের এ স্বাধীনতায় বিশাল জনগোষ্ঠীর অংশীদারি একটি অবিস্মরণীয় ও অভূতপূর্ব অর্জন। এ অর্জনে বাংলার তরুণ তাজা তপ্তপ্রাণ নেতৃত্বের সিংহাসনে বসিয়েছিল এ দেশের রাজনীতির অতি সাধারণ স্তর থেকে উঠে আসা বাংলার মুকুটহীন সম্রাট, মানুষের হৃদয়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত শেখ মুজিবকে। তিনি বাংলার মানুষকে বিশ্বাস করতেন অকপটে এবং তাঁর হৃদয়ের দুয়ার শুধু অবারিতই নয়, তিনি গণভবনে যাননি সাধারণ মানুষের জন্য গণভবনের লৌহকপাট সর্বদা উন্মুক্ত ও অবারিত রাখা সম্ভব নয় বলে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি এবং অনেকেই সম্পূর্ণ নিরাপত্তাবিবর্জিত ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের তাঁর নিজস্ব বাড়ি থেকে তাঁকে স্থানান্তরের জন্য অনেক অনুরোধ-উপরোধ কাকুতি-মিনতি করে ব্যর্থ হওয়ার পরও অন্তত রাতযাপনের জন্য হলেও গণভবনে অবস্থানের জন্য কী পীড়াপীড়ি ও অনুরোধই না করেছি। এ প্রশ্নে শুধু উপেক্ষাই নয়, অনেক ব্যঙ্গবিদ্রƒপও তিনি করেছেন, টিপ্পনীও কেটেছেন। সবকিছু সহ্য করেও আমরা অনুরোধ ও চাপ সৃষ্টির প্রাণান্ত প্রচেষ্টা থেকে সরে আসিনি। আমাদের অনুরোধ-উপরোধ যখন কার্যকর হলো না, তখনো নাছোড়বান্দার মতো আমরা তাঁর রাতযাপনের স্থানটির নিরাপত্তা অনেক গুণে বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছি। আজকের প্রজন্ম বিস্ময়াভিভূত ও আশ্চর্যান্বিত হবেন, তিনি অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে নিরাপত্তার সেই প্রস্তাবগুলো উপেক্ষা করে তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে প্রায়শই বলতেন, ‘দরদ দেখাও মিয়ারা! আমি জানি তোমাদের উদ্বিগ্নতার কারণ। কিন্তু তোমরা যেটা জানো, সেটা আমার উদাসীনতা নয়, বাংলার মানুষের প্রতি আমার অকুণ্ঠ বিশ্বাস। আমার প্রতি বাংলার মানুষের ভালোবাসা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সবাই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতেন বলেই আমাকে বাংলাদেশের কোনো কারাগার তো দূরে থাক, ক্যান্টনমেন্টেও রাখতে সাহস পায়নি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হওয়ার পর তারা আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সরিয়ে নিয়ে সেনানিবাসে অবরুদ্ধ করে কিন্তু তাতেও কি তাদের শেষরক্ষা হয়েছিল?’ এ প্রশ্নে আমরা নিরুত্তর থাকলেও পরিপূর্ণ আশ্বস্ত হতে পারতাম না, মনকেও প্রবোধ দিতে পারতাম না। প্রতিনিয়তই আমাদের আন্তরিক অনুরোধ বিদ্রুপ করে তিনি বলতেন, আমি না বলেছি, I love my people.. আমাকে ধমক দিয়ে বলতেন, ডেভিড ফ্রস্টের কাছে আমি যখন বললাম, আমার চরিত্রের সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো, I love my people too much. তুমি কি মনে কর এটি চটকদার রাজনৈতিক একটি কথার কথা ছিল? হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে কর্মী থেকে নেতা এবং জনগণের আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছি। এ কারণে আমি যা বলি, সেটা বিশ্বাস করি। আর যেটা বিশ্বাস করি না, সেটা কখনো বলি না। প্রচ- অস্বস্তি এবং দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের কালো মেঘের মতো একটা অজানা আশঙ্কা ও আতঙ্ক নিয়ে সেদিনের মতো নিশ্চুপ হয়ে যেতাম।

মুজিব ভাইয়ের নেতৃত্বের যে আসন, সেটি মানুষের হৃদয়ে তিল তিল করে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। সে আসনটি ছিল মোগলদের হীরকখচিত ময়ূর সিংহাসনের চাইতেও মূল্যবান, অতুলনীয়। তাই তো প্রশ্ন এসে যায়, ১৫ আগস্টের পর সারা বাংলাদেশ আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো বিস্ফোরিত তো হলোই না, বরং নীরব, নিথর, নিস্পৃহ, নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে রইল কেন? এ নিস্পৃহতার কী কারণ তার পূর্ণ বিশ্লেষণের ভার আমি ইতিহাসের কাছেই অর্পণ করতে চাই। তবু আমার নিজের ধারণা, ঘটনার আকস্মিকতা এবং নৃশংস নির্মমতায় সমগ্র জাতি হতচকিত হয়ে গিয়েছিল, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, বাকশাল গঠন প্রক্রিয়ার প্রকোপে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। অনেক দল, বিশেষ করে ভ্রান্ত বামের সংমিশ্রণে আওয়ামী লীগ তার নিজস্ব সাংগঠনিক শক্তি হারিয়ে ফেলে। ভাগের মা গঙ্গা পায় না, এমনই এক রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল সে সময়। অন্যদিকে যাদের ওপর সংগঠনগুলোর দায়িত্ব অর্পিত ছিল তারা সবাই দায়িত্ব পালনে কেবল ব্যর্থই হননি, অনেকটা অস্বীকৃতি জানানোর মতোই ছিল তাদের নিস্পৃহতা। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, রক্ষীবাহিনী রাজনৈতিক নির্দেশের অভাবে সেনাবাহিনী থেকে পরিত্যক্ত ২৬ জন ধিকৃত মানুষকে প্রতিরোধ করার জন্য এগিয়ে আসেনি।

বঙ্গবন্ধুকে অকালে হারানোর ক্ষতবিক্ষত আমার হৃদয়কে দীপ্তিহীন আগুনের শিখায় দগ্ধীভূত করে যখন একান্তে ভাবী, বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের গৃহটি আক্রান্ত হওয়ার পর ২ ঘণ্টার কাছাকাছি সময় তিনি হাতে পেয়েছিলেন। এই সময়ের মধ্যে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে এবং রক্ষীবাহিনীর যিনি রাজনৈতিক দায়িত্বে ছিলেন তাদের সবার সঙ্গে টেলিফোনে বারবার পরিস্থিতি জানিয়ে সাহায্যের জন্য, অর্থাৎ ওদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন। কিন্তু বারবার টেলিফোন করার পরও কারও কাছ থেকে তিনি কোনো সহযোগিতা পাননি শুধু কর্নেল জামিল ছাড়া। আমি প্রত্যয়দৃঢ় চিত্তে মনে করি, সশস্ত্র বাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তো বটেই, ন্যূনতমভাবে তাদের দেহরক্ষীদের নিয়ে বের হলেও দুষ্কৃতকারীরা পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করার পথ খুঁজে পেত না। কিন্তু দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধুর, মর্মান্তিক শাহাদাতের আগে তিনি বুকভরা বেদনা নিয়ে উপলব্ধি করে গেলেন, তিনি কতটা একা, নিঃস্ব ও রিক্ত!

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে কিন্তু দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর ডাকে যারা সাড়া দেননি, নিষ্ক্রিয়, নিস্পৃহ ও নিস্তব্ধ থেকেছেন, তাদের শনাক্ত করে আওয়ামী লীগের মতো সংগঠন থেকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরে থাক, তাদের চিহ্নিত করে প্রতিবাদ ও জবাবদিহিতা পর্যন্ত চাওয়া হয়নি। বারবার সাহায্য চেয়েও নিষ্ফল হয়ে একাকিত্ব ও অসহায়ত্বের বেদনা নিয়ে বঙ্গবন্ধু মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আজও সেই গ্লানি থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। যারা নিষ্কলুষ চিত্তে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন, তারা আজও কান পাতলে হয়তো ইথারে তাঁর বিদেহী আত্মার এই বেদনার ধ্বনি শুনতে পান।

১৫ আগস্ট কোনো সেনা অভ্যুত্থান বা বিদ্রোহ হয়নি। কোনো জনতার বিপ্লবও সংঘটিত হয়নি। অন্যদিকে হত্যাকারীরা সংখ্যায় যে কেবল ২৬ জন ছিল তা-ই নয়, তাদের প্রায় সবাই সামরিক বাহিনী থেকে হয় বহিষ্কৃত, নয় চাকরিচ্যুত। এখানে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য নয়, পরিস্থিতি ব্যাখ্যার প্রয়োজনে আমি উল্লেখ করতে চাই, ১৫ আগস্ট আমার হৃদয়ের যে রক্তক্ষরণ, তা আজও বন্ধ হয়নি। এর প্রধানতম কারণ, তখন আমার হাতে কোনো সংগঠনই ছিল না। ’৭১-এর ২৫ মার্চ সারা বাংলাদেশ যখন পৈশাচিক শক্তি সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হলো এবং কারফিউ জারি করে নির্বিচারে গুলি ছুড়ে নিরীহ নিরস্ত্র নিতান্ত সহজ সরল মাটির মানুষগুলোকে হত্যা করা হলো, তখন হৃদয়ের সমস্ত যন্ত্রণাকে প্রশমিত করে প্রতিরোধ ও প্রতিহত করার সংকল্প ও পূর্ব পরিকল্পনা সামনে এগিয়ে নেওয়ার প্রজ্বালিত আকাক্সক্ষাকে নির্দিষ্ট কর্মসূচিতে রূপান্তরিত করি। কারণ, ২৫ মার্চে আমার এক হাতে ছিল বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণতূর্য (তখন আমি ছাত্রলীগের সভাপতি এবং স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা)। কিন্তু ১৫ আগস্টে হৃদয়ে শুধু রক্তক্ষরণ হয়েছে, কিছুই করতে পারিনি।

১৫ আগস্টের কিছুদিন আগেও আমি যুবলীগের মহাসচিব ছিলাম। সেখান থেকেও আমাকে সুকৌশলে সরিয়ে দিলে (মণি ভাই এর বিপক্ষে ছিলেন) আমি শুধু নিষ্ক্রিয় ও নিস্তব্ধই হয়ে যাইনি, হয়তো ওই প্রতাপশালী অংশের কেউ আমাকে রক্ষীবাহিনী অথবা আততায়ী দিয়ে হত্যা করিয়ে তারা নিজেরাই শোকসভা, প্রতিবাদসভা ও মিছিল করত। আমার সুহৃদ, শুভাকাক্সক্ষীদের এমন হুঁশিয়ারির পরিপ্রেক্ষিতে আমি আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হই। সব ধরনের সংগঠন থেকেই আমাকে বিযুক্ত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের খবর আমি ওই দিন ভোরে আমার পিতার টেলিফোনের মাধ্যমে জানতে পারি। আমি যে বন্ধুর বাসায় থাকতাম, তার টেলিফোন নম্বর কেবল আমার পরিবারের সদস্যদেরই জানা ছিল। খবরটি শুনে পিঞ্জিরাবদ্ধ ব্যাঘ্রের ন্যায় বন্ধুর বাসায় ছটফট করছিলাম। মানসিক অবস্থা এমন ছিল যে, মন চাইছিল চিৎকার করে একাকী রাস্তায় বেরিয়ে একাই প্রতিবাদ করতে থাকি। আমার বন্ধু ও তাঁর স্ত্রী আমাকে নিবৃত্ত করার জন্য নানা ধরনের সান্ত্বনা ও প্রবোধ বাণী শোনাচ্ছিলেন। তাঁদের মূল কথা ছিল, ধৈর্য ধর, পরিস্থিতি পর্যালোচনা কর, বিশ্বস্তদের সঙ্গে যোগাযোগ কর। যাদের সঙ্গেই যোগাযোগ করেছি, তারাই আমাকে ধৈর্যধারণ ও শান্ত থাকতে বলেছেন। অকস্মাৎ এমন কিছু যেন না করে বসি যেটি আত্মঘাতী ও অনর্থক বিপৎসংকুল পরিস্থিতিতে আমাকে ঠেলে দেবে। জীবনে আমি আর কখনো এতটা অসহায়বোধ করিনি।

আজকে একটি নতুন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দেশ আজ মূলত কার্যকর বিরোধী দলশূন্য। সরকারি মারাত্মক ভুলের বিরুদ্ধে একটা ফলপ্রসূ ও কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলা আজ অসম্ভব প্রায়। কেন এমন হলো? কী করেই-বা হলো? সমস্ত রাজনৈতিক অঙ্গন আজ নীরব, নিস্তব্ধ ও নিস্পৃহ প্রায়। ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনের মোড়কে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির লক্ষ্যে তো সফল আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। আজ কেন রাজনীতির এ দৈন্যদশা! অনেকে হয়তো ঠাট্টা করে বলবেন, শেখ হাসিনা মনোমুগ্ধকর ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে গোটা জাতিটাকেই নিদ্রাভিভূত করে রেখেছেন। শেখ হাসিনার হাতে পরম নিশ্চিন্তে গোটা জাতির ভালোমন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণের দায়ভার অর্পণ করে গোটা জাতি নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে ঘুমোচ্ছে। এ ঘুম যেন কুম্ভকর্ণের ঘুমের চাইতেও মারাত্মক ও বিপজ্জনক। এ ঘুম জাতির জন্য তো বটেই, স্বয়ং শেখ হাসিনার জন্যও মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে। সেটি এতই ভয়াবহ রূপ নিতে পারে যে, সামাজিক শৃঙ্খলা তো চূর্ণবিচূর্ণ হবেই, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্যও একটা কঠিন হুমকির পরিবেশ তৈরি করবে। সেটি আমার ও আমজনতার জন্য তো বটেই, শেখ হাসিনার জন্যও মারাত্মকভাবে আশঙ্কাজনক।

আজ যেদিকে তাকাই, সবাই যেন আওয়ামী লীগ। একদিন যারা গণবাহিনী করেছেন, থানার পর থানা লুট করেছেন, খাদ্য গুদামে আগুন দিতে দ্বিধাবোধ করেননি, ঈদের জামাতে সংসদ সদস্য হত্যাকে অত্যন্ত বীরোচিত কাজ মনে করেছেন, যাদের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে মানুষের হৃদয় সর্বদা আতঙ্কিত ও সন্ত্রস্ত থাকত, ১৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনীর ট্যাংকে উঠে যারা রাইফেল উঁচিয়ে উন্মাদের মতো উল্লাস প্রকাশ করেছেন, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অসম্মানজনক সেøাগানে বিষোদগার করেছেন, ছাত্রলীগে আমরা যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতাম, তাদের দেখলেই নিষ্ঠুর নির্মম ব্যঙ্গ করে ‘মুজিববাদের কাঁধে চড়ে আমেরিকা যাব গো’, ‘শেখ মুজিবের কাঁধে চড়ে দিল্লি যাব গো’ বলে যারা সুর করে গান গাইত, এখন তারাও আওয়ামী লীগ! ডানে তাকালেও আওয়ামী লীগ, বাঁয়ে তাকালেও আওয়ামী লীগ। সামনে-পেছনে,  ওপরে-নিচে ডান-বাম এমনকি স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধীরাও আজ আওয়ামী লীগের তকমা লাগিয়ে বীরদর্পে সমাজের সর্বত্রই বিচরণ করছেন। তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি অবস্থা ও অবস্থান নেহাতই কম নয়। তাদের মধ্যে যারা ১৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনীর ট্যাংকে উঠে রাইফেল উঁচিয়ে অদম্য উল্লাস প্রকাশ করেছেন, তাদেরই কেউ কেউ শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। আপাতত নেই, তবে আবার হতে কতক্ষণ! স্বাধীনতার শত্রু যারা তারাও আজ নৌকার সমর্থকই শুধু নন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী! এই নব্য এবং হাইব্রিড আওয়ামী লীগ নেতাদের কনুইয়ের গুঁতোয় কত যে নিবেদিত নেতা ও কর্মী ধরাশায়ী হয়েছেন, কতজন যে রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছানির্বাসনে গিয়েছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। করোনা, ডেঙ্গু থেকে শুরু করে অনেক প্রাণঘাতী অসুখ আজ সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু তার চাইতেও সর্বনাশা ব্যাধি হলো নব্য আওয়ামী লীগারদের দৌরাত্ম্য। দেশ আজ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। প্রশাসন ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি এমনভাবে মিশে গেছে যে, স্বাভাবিক সমাজব্যবস্থা ও দুর্নীতির সঙ্গে বিভাজন করাই দুরূহ কাজ। এটা যিনি করতে পারবেন, তিনি গৃহযুদ্ধ থেকে আমেরিকাকে রক্ষাকারী আব্রাহাম লিঙ্কনের সম্মান পাবেন- এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।

পাশবিক শক্তির হাতে মর্মান্তিকভাবে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন ৪৭ বছর হয়ে গেল। এই দীর্ঘ সময়ে দেশ স্বৈরাচারের খাদে পড়েছে। সেখান থেকে কিছু দিনের জন্য হলেও টেনে-হিঁচড়ে তুলে গণতান্ত্রিক পথে পরিক্রমণের জন্য তাকে কোনোরকমে খাড়া করা সম্ভব হলেও আবার হোঁচট খেয়ে সেই স্বৈরাচারের গহিন অন্ধকারেই নিপতিত হয়েছে। অনেক চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে জনগণ যখন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করল, তখন গণতন্ত্রের অবস্থান সম্পর্কে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল। কিন্তু কপাল মন্দ দেশের, দুর্ভাগ্য প্রান্তিক জনতার। শেখ হাসিনার মন্ত্রিপরিষদে ডান-বামের সেসব চেনামুখের কেউ কেউ ঢুকে গেলেন, যারা গণতন্ত্রের বিপক্ষে আমজনতার বিরুদ্ধে অনেকবার অবস্থান নিয়েছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরাও ক্ষেত্রবিশেষ আওয়ামী লীগের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছেন। সশস্ত্র বাহিনীর ও তাদের দোসর কিছু ধিকৃত ব্যক্তি ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। সত্যিই বিচিত্র এই দেশ, বড় দুর্ভাগা এ দেশের মানুষ!

শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা। প্রগতিশীল জনভিত্তির রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে তিনি ব্যর্থ হলেন। জনগণ যে তিমিরে ছিল, সে তিমিরেই অবরুদ্ধ রয়ে গেল। আমরা যেন এক অবরুদ্ধ জাতি। অন্ধকার থেকে আলোর পথে সূর্যস্নাত হয়ে আমরা বেশিক্ষণ হাঁটতে পারি না। জনগণ দুর্দমনীয় আন্দোলন করে বারবার বিজয়ী হয়। কিন্তু আবার অদৃশ্য ষড়যন্ত্রের নির্মম কশাঘাতে তারা শুধু জর্জরিতই হয় না, তাদের গৌরবদীপ্ত মুখমন্ডল কেবল কলঙ্কিত হয় না কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে পরাজিত শত্রুরা পায়ে পায়ে চুপিসারে ক্ষমতায় আসন পেয়ে যায়। আবার সেই ষড়যন্ত্রের খেলা শুরু হয়, আবার জনসমাদৃত নেতারা পিছু হটতে শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে পরাজিত হতে বাধ্য হয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নেতা বা নেত্রীর স্তাবক নেতৃত্ব এমন সুকৌশলে দলের অভ্যন্তরে এবং ক্ষমতাসীন মূল নেতৃত্বের চারপাশে আসন পেতে বসে যে, মূল নেতৃত্বের গণতান্ত্রিক চেতনাটিকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলে এবং জাতি যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই নিক্ষিপ্ত হয়।

                লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা

সর্বশেষ খবর