মহান আল্লাহর হকের পাশাপাশি বান্দার হকের প্রতিও গুরুত্বারোপ করা শরিয়তের একটি অতীব জরুরি বিষয়। কাউকে কিছু মেপে দেওয়ার সময় সঠিকভাবে ওজন করে দেওয়া কাম্য। এতে কমবেশি করা চরম অন্যায়, চরিত্রহীনতা এবং শরিয়ত পরিপন্থী কাজ। ইসলাম ধর্মে একে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজে খুব সম্ভব দীন থেকে দূরত্ব কিংবা জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে এ অপরাধের মাত্রা খুব বেশি লক্ষণীয়। নবী শুয়াইব (আ.)-এর জাতির মধ্যে এ অপরাধের মাত্রা ছিল খুবই বেশি। মহান আল্লাহ আল কোরআনে এ জাতির ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ‘আর মাদিয়ানবাসীদের প্রতি তাদের ভাই শুয়াইবকে পাঠিয়েছিলাম। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো মাবুদ নেই। আর মাপে ও ওজনে কম দিও না। আমি তোমাদের সুখে-শান্তিতে দেখছি, কিন্তু তোমাদের ব্যাপারে এক পরিবেষ্টনকারী দিনের আজাবের আশঙ্কা করছি। আর হে আমার সম্প্রদায়! তোমরাই ইনসাফের সঙ্গে মাপ ও ওজন পূর্ণ করে দাও এবং লোকদের তাদের দ্রব্যাদি কম দিও না। আর পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা করে বেড়িও না।’ (সুরা হুদ, আয়াত ৮৪-৮৫) নবী শুয়াইব (আ.)-এর ব্যাপারে রসুল (সা.) বলেছেন, তিনি খতিবুল আম্বিয়া। নবীদের খতিব। তিনি অত্যন্ত চমৎকার বর্ণনায় তাঁর জাতিকে বোঝালেন এবং সঠিক পথে নিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু সবকিছু শুনে জাতি ওই উত্তরই দিল, যে উত্তর মূর্খ জাতি সংশোধনকারীদের দিয়ে থাকে। এমনকি তাঁর সঙ্গে বিদ্রƒপ ও মশকরা আরম্ভ করে দিল। তারা বলতে আরম্ভ করল, ‘হে শুয়াইব! তোমার নামাজ কি তোমাকে এ শিক্ষা দেয় যে, আমাদের বাপ-দাদারা যাদের উপাসনা করত আমরা তাদের বর্জন করি? অথবা আমরা আমাদের ধনসম্পদে আমাদের যা ইচ্ছা, তা করা ত্যাগ করি? তুমি তো বড়ই সহনশীল, ভালো মানুষ।’ (সুরা হুদ, আয়াত ৮৭) নবী শুয়াইব (আ.)-এর নামাজ গোত্রের সবার কাছে প্রসিদ্ধ ছিল। তিনি প্রচুর নফল ইবাদত করতেন। এজন্য তার নির্দেশনাকে বিদ্রƒপ করে নামাজের দিকে সম্বন্ধ করল। মানে তারা বোঝাতে চাচ্ছিল, এ নামাজই (আল্লাহর পানাহ) এমন ভুল বার্তা তোমাকে দেয়। তাদের এ কথার দ্বারা বোঝা যায়, তারা দীন ও শরিয়ত শুধু ইবাদতেই সীমাবদ্ধ মনে করত। লেনদেনে আবার কীসের সীমাবদ্ধতা! যে যেভাবে চায় লেনদেন করবে। এতে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করা দীনের কোনো বিষয় নয়। তাদের মূর্খরা এমন ধারণাই পোষণ করত। এত কষ্টদায়ক ও তিক্ত কথা শোনার পর আবারও সহমর্মিতার সঙ্গে তাদের সঠিক পথে আনার জন্য জানপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু যখন মানেনি তখন আজাবের কথা বলে ভয় দেখালেন। তিনি বললেন, ‘আর হে আমার সম্প্রদায়! আমার বিরোধিতা যেন তোমাদের জন্য এর কারণ না হয় যে তোমাদের ওপরও সে রকম কিছু আপতিত হলো, যা আপতিত হয়েছিল নুহের সম্প্রদায়, হুদের সম্প্রদায় বা সালেহের সম্প্রদায়ের ওপর। আর লুতের সম্প্রদায় তো তোমাদের থেকে মোটেই দূরে নয়।’ (সুরা হুদ, আয়াত ৮৯) অর্থাৎ স্থানের দিক থেকেও লুত (আ.)-এর জাতির উল্টে যাওয়া এলাকা মাদিয়ানের কাছাকাছি। সময়ের দিক থেকেও তোমাদের খুব কাছাকাছি। এসব ঘটনা তো তোমাদের স্মৃতিশক্তিতে সজীব থাকার কথা। এসব থেকে শিক্ষা গ্রহণ কর। নিজের জিদ থেকে ফিরে আসো। শুয়াইব (আ.)-এর জাতি কঠিন আজাবে নিপতিত হলো এবং এক ভয়ংকর শব্দ তাদের কলিজা ছিঁড়ে দিল এবং তাদের এমনভাবে নিঃশেষ করে দেওয়া হলো যে, যাতে এখানে কোনো আবাদিই না থাকে। বোঝা গেল, মাপে কমবেশি করা সাধারণ কোনো অপরাধ নয়; বরং তা মারাত্মক পর্যায়ের অপরাধ। এ অপরাধের কারণে আল্লাহ ফসল উৎপাদন হ্রাস করে দুর্ভিক্ষে নিপতিত করেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যারা মাপে কমবেশি করবে, আল্লাহ তাদের ফসল উৎপাদনে হ্রাস সৃষ্টি করবেন এবং তাদের ওপর দুর্ভিক্ষ চাপিয়ে দেবেন।’ (আত-তারগিব ওয়াত তারহিব)
লেখক : শিক্ষা সচিব ও মুহাদ্দিস জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ