বুধবার, ৪ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ছাত্রলীগের সেই ইতিহাস

তোফায়েল আহমেদ

ছাত্রলীগের সেই ইতিহাস

এ বছর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বার্ষিকী উদ্‌যাপন করছে। ১৯৭৩-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে নেতা-কর্মীদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস।’ বাঙালির আধুনিক কালের ইতিহাস অনুযায়ী কথাটি আক্ষরিক অর্থেই সত্য। ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ- এ চারটি নাম সমার্থক। বাঙালি জাতিসত্তাকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় সত্তায় অভিষিক্ত করতে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার সুদীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, অসীম ত্যাগ ও অবদান অনস্বীকার্য। নিজ জাতির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাসের প্রতিটি ধাপে অগ্রণী ভূমিকা পালনের এমন দৃষ্টান্ত আন্তর্জাতিক ছাত্র রাজনীতিতে দুর্লভ। এজন্য বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগকে অভিহিত করেছিলেন অগ্রগামী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে। অগ্রসর ভূমিকা পালনে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছাত্রলীগ গৌরবময় জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি ধাপেই আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত করতে হারিয়েছে অসংখ্য নেতাকর্মী। প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা সংগ্রামে এই মহত্তর আত্মদান একটি ছাত্র সংগঠনের জন্য বিরল গৌরবের।

বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগের জয়যাত্রা শুরু হয়। মাত্র ৪.৫% লোক যে উর্দু ভাষায় কথা বলে সেই জনবিচ্ছিন্ন ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ ও শাসক মুসলিম লীগের প্রতারণামূলক অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মুসলিম লীগের তরুণ নেতৃত্ব গঠন করে ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধু তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংগঠিত করে ছাত্রসমাজের মাঝে রাজনৈতিক অধিকারের চেতনা জাগ্রত করার লক্ষ্যে ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় গঠিত হয় ছাত্রলীগ। গঠন প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, নূরউদ্দিন আহমেদ, এম এ ওয়াদুদ, নঈমউদ্দিন আহমেদসহ ১৪ জন প্রগতিবাদী ছাত্রনেতা। প্রতিষ্ঠার মহতীলগ্নে গঠনমূলক ১০টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সামনে রেখে ছাত্রলীগের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি; দেশরক্ষা; স্বার্থান্বেষী মহলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম; ছাত্রসমাজকে দলীয় রাজনীতিমুক্ত রাখা; নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে জিহাদ; আধুনিক ধ্যানধারণা ও কৃষ্টির মাধ্যমে উন্নত চরিত্রের অধিকারী বিপ্লবী কর্মী সৃষ্টি; জাতি ও দেশের কল্যাণে ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা; জনকল্যাণে নিয়োজিত থাকা ও গণস্বার্থবিরোধী কর্মে সংগ্রাম; প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি আদায়; দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও চোরাকারবারিদের উচ্ছেদ সাধন এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছাত্র আন্দোলন পরিচালনার যে রেওয়াজ প্রচলিত আছে তার ধ্বংসসাধন। উপরোক্ত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ধারকবাহক ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ছাত্রসমাজের অধিকার শুধু নয়, গোটা বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামী চেতনার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

প্রতিষ্ঠার পরপরই মার্চের ২ তারিখ ছাত্রলীগের উদ্যোগে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। আহ্বায়ক নির্বাচিত হন ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সহসভাপতি ছাত্রলীগ নেতা সামছুল আলম। রাষ্ট্রের অন্যতম ভাষা বাংলার দাবিতে ১১ মার্চ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে প্রদেশব্যাপী হরতাল, সভা ও বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ পালিত হয়। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে এটি ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম হরতাল। এদিন হরতাল কর্মসূচিতে পিকেটিং করতে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ অন্য নেতৃবৃন্দ আহত ও গ্রেফতার হন। হরতালে সরকারের নৃশংস ভূমিকার প্রতিবাদে ছাত্রলীগের আহ্বানে ১২ মার্চ সারা দেশে প্রতিবাদ সভা, ১৩ মার্চ সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট, ১৪ মার্চ সারা বাংলায় হরতাল পালিত হয়। ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের ডাকে লাগাতার আন্দোলনে টনক নড়ে সরকারের। ১৫ মার্চ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন গভর্নর হাউসে (বর্তমান বাংলা একাডেমির বর্ধমান ভবন) মুসলিম লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক ডাকেন। বৈঠক চলাকালে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে ও নেতৃবৃন্দের মুক্তি দাবিতে গভর্নর হাউসের বাইরে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ প্রণীত ও ছাত্রলীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অনুমোদিত সাত দফা মেনে নেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রী বরাবর দাবি জানান। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন সাত দফা দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন এবং সরকারের পক্ষে খাজা নাজিমউদ্দিন ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে ছাত্রলীগ নেতা কামরুদ্দীন আহমদ একটি চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করেন। সাত দফা দাবিসংবলিত চুক্তিনামাটি মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন মেনে নেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ গ্রেফতার ছাত্রনেতাদের মুক্তি দেওয়া হয়। শাসকগোষ্ঠী ছাত্রনেতাদের মুক্তি দিয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজকে আপাত শান্ত করেই মেতে ওঠে নতুন চক্রান্তে। সাত দফা দাবির ৩ নম্বর দফায় বলা হয়েছিল, ‘১৯৪৮ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদে বেসরকারি বিল আলোচনার জন্য নির্ধারিত তারিখে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার এবং তাকে পাকিস্তান গণপরিষদে এবং কেন্দ্রীয় চাকরির পরীক্ষা দিতে উর্দুর সমান মর্যাদা দানের নিমিত্ত একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে।’ আর ৪ নম্বর দফায় বলা হয়েছিল, ‘পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে এপ্রিল মাসে একটি প্রস্তাব তোলা হবে যে, প্রদেশের অফিস-আদালতের ভাষা ইংরেজির স্থলে বাংলা হবে।’ এ দুটি দফা নিয়ে কর্তৃপক্ষের চক্রান্ত পরিস্থিতিকে অশান্ত করে তোলে। প্রতিবাদে ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে একটি বিক্ষোভ-মিছিল আইন পরিষদের সামনে অবস্থান নিলে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে, বঙ্গবন্ধুসহ ১৯ জন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী আহত হন। ১৯ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন এবং ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমাবেশে ও ২৪ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দুই স্থানেই দম্ভভরে ঘোষণা দেন, ...Urdu only Urdu shall be National and State language of Pakistan and none else... অর্থাৎ ‘...উর্দু কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় এবং রাষ্ট্র ভাষা অন্যকিছু নয়...।’ এর প্রতিবাদে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ গর্জে উঠেছিলেন। সভাস্থলেই তাৎক্ষণিক ‘No’ ‘No’ অর্থাৎ ‘না’ ‘না’ প্রতিবাদ ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছিল।

’৪৮-এর ১১ মার্চের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন, ’৪৯-এ আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন, ’৫০-এ গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট তৈরি, ’৫২-এর অমর একুশে ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করায় ছাত্রলীগ নেতৃত্ব প্রদান করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত আদর্শ-উদ্দেশ্যের প্রতি অবিচল থেকে ছাত্রলীগ অর্জন করে অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ। যার প্রতিফলন ঘটে ’৫৩তে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে মুসলিম ছাত্রলীগের স্থলে ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ নামকরণ করা হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের অসাম্প্রদায়ীকরণের আগেই ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক করা হয়। একই বছর ডাকসু ও বিভিন্ন হল সংসদের নির্বাচনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট’ নামে নির্বাচনী জোট গঠিত হয়। ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সংসদ নির্বাচনে আশাতীত সাফল্য অর্জন করে এবং মুসলিম লীগ সমর্থিত নিখিল পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করতে বাধ্য করে। ছাত্রলীগের প্রস্তাবে ও নেতৃত্বে গঠিত ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্টের’ চেতনাই পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে ’৫৪-এর ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠনের ভিত্তি তৈরি করে এবং হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করে মুসলিম লীগকে বিদায় দেয়। নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২২২টি আসনেই যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী বিজয়ী হয়। যুক্তফ্রন্ট গঠনে এবং যুক্তফ্রন্টের বিজয়ে ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এরপর ’৫৫-এর ২১, ২২ ও ২৩ অক্টোবর, আওয়ামী মুসলিম লীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ গঠনে নেতৃত্ব প্রদান করেন। ’৪৮-এ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ’৫৫ পর্যন্ত কালে সাত বছরের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত চেতনার বলে ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অগ্রগামী বাহিনী ছাত্রলীগের মাধ্যমেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটান। যে আদর্শ-উদ্দেশ্য ধারণ করে ছাত্রলীগের শুভসূচনা হয়েছিল তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার মধ্য দিয়েই ছাত্রলীগের মতাদর্শিক চেতনার ভিত্তি স্থাপিত হয়।

’৫৮তে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে বিভিন্ন ফরমান-আদেশ বলে রাজনীতি করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্তদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে বিভিন্ন মেয়াদে যেমন, ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, বেত্রাঘাত, অর্থ জরিমানাসহ বিভিন্ন ধরনের দণ্ড প্রদানের ব্যবস্থা করে। ফলে সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় ছাত্রলীগ ‘শিল্প-সাহিত্য সংঘ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গঠন করে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে সংগঠনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। ’৬০-এর দশকের শুরুতে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে বিশেষ করে শরীফ কমিশন ও হামুদুর রহমান কমিশনের শিক্ষানীতি, রবীন্দ্রচর্চা নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে, ’৬৪তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রুখতে ছাত্রলীগ সমমনা সংগঠনগুলোকে নিয়ে সাহসী ভূমিকা পালন করে। ’৬৬-তে ৬ দফা দেওয়ার পর আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগের হুমকি প্রদান করেন। শুরু হয় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের ওপর দমন নীতি। বঙ্গবন্ধুর ওপর ৬টি মামলা দায়ের করে গ্রেফতারি ও হয়রানি ’৬৬-এর এপ্রিলজুড়ে চলতে থাকে এবং ৮ মে রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। এরপর ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। এ রকম চরম দমন-নির্যাতনের ফলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকে। ’৬৭-এর ১৭ জানুয়ারি, সেদিন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি নির্বাচিত হই। তখন ৬ দফার আন্দোলন চলছে। বঙ্গবন্ধু কারাগারে অন্তরিন। সেদিন রাতেই প্রিয় নেতার কাছ থেকে একটা গোপন পত্র পাই। তিনি লিখেছেন, ‘স্নেহের তোফায়েল, তুই ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হওয়ায় আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, এই ডাকসুর নেতৃত্বে বাংলাদেশে একটি আন্দোলন গড়ে উঠবে।-মুজিব ভাই।’ সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করার জন্য তাঁকে প্রধান আসামি করে সর্বমোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ তথা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করে ঢাকা সেনানিবাসের একটি কক্ষে আটকে রাখে। এর প্রতিবাদে ’৬৮-এর ২৬ ডিসেম্বর ডাকসুর পক্ষ থেকে আমি সহসভাপতি এবং নাজিম কামরান চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক, আমরা সমগ্র পাকিস্তানে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ‘কালো পতাকা উত্তোলন ও প্রদর্শন’ এই কর্মসূচি গ্রহণ করি। ’৬৯-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ‘ডাকসু’ কার্যালয়ে আমার সভাপতিত্বে এবং চার ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফরম ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে ৬ দফা দাবি আদায় এবং বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করতে ৬ দফাকে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলনসমেত ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি ঘোষণা করি। আমরা জানতাম, আমাদের ১১ দফায় ধারিত আছে গণমানুষের দাবি। ৮ জানুয়ারি সম্মিলিত বিরোধী দল সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আটটি বিরোধী দলের ঐক্যফ্রন্ট কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে আট দফাভিত্তিক ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে। ৯ জানুয়ারি দেশের আটটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের ঐক্যের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ তথা Democratic Action Committee সংক্ষেপে ‘DAC’ গঠন করে। ১২ জানুয়ারি ‘DAC’ প্রাদেশিক সমন্বয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং আট দফা দাবির ভিত্তিতে ১৭ জানুয়ারি ‘দাবি দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৭ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররমে ‘DAC’-এর আর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জমায়েত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলায় অনুষ্ঠিত হয়। ’৬৯-এর ১৭ থেকে ২৪ জানুয়ারি, মাত্র সাত দিনের প্রবল গণ-আন্দোলনে সংঘটিত হয় সর্বব্যাপী গণ-অভ্যুত্থান। এই সাত দিনে ছাত্রলীগের উদ্যোগে ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে মতিউর, মকবুল, রুস্তম, মিলন, আলমগীর, আনোয়ারাসহ শহীদের রক্তে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল বাংলার ছাত্রসমাজ। ’৬৯-এর ১ ফেব্রুয়ারি স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বেতার ভাষণে কিছু বক্তব্য দেন, যা বিরোধী দল এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক প্রত্যাখ্যান করা হয়। ৬ ফেব্রুয়ারি আইয়ুর খান ঢাকায় আসেন এবং এক সংবাদ সম্মেলনে দেশরক্ষা আইন ও অর্ডিন্যান্সের প্রয়োগ বাতিল করেন। ৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে ‘শপথ দিবস’ পালিত হয়। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক এবং সভার সভাপতি হিসেবে পিনপতন নীরবতার মধ্যে ৪৫ মিনিট বক্তৃতা করি। পুরো বক্তৃতাতেই বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দির মুক্তি ও ঐতিহাসিক ১১ দফা ব্যাখ্যা করে ছাত্রদের রাজনীতি করার যৌক্তিকতা তুলে ধরি। আমার বক্তৃতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গগনবিদারী কণ্ঠে স্লোগান তুলেছিলাম- ‘শপথ নিলাম শপথ নিলাম, মুজিব তোমায় মুক্ত করব; শপথ নিলাম শপথ নিলাম, মা-গো তোমায় মুক্ত করব।’ এ স্লোগানের দুটি লক্ষ্যই আমরা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জন করি। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পদত্যাগ, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার, বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯ ফেব্রুয়ারি লাগাতার সংগ্রামের পর ২০ ফেব্রুয়ারি সান্ধ্য আইনের মধ্যে আমরা মশাল মিছিল করি। পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস। ’৬৯-এ এ দিনটি পালিত হয়েছিল সগৌরবে। ’৫২-এর রক্তধারা ’৬৯-এর স্রোতে এসে মিশেছিল। সেদিনও পল্টন ময়দানে ছিল জনসভা। সভায় সভাপতির বক্তৃতায় বলেছিলাম, ‘এই দিনটি আত্মপ্রত্যয়ের দিন, আত্মপরিচয় দেওয়া ও নেওয়ার দিন। ১৭ বছর আগে এই দিনটি ছিল শুধু মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামের দিন। আজ ১৯৬৯-এ এদিনটি জনগণের সার্বিক মুক্তিসংগ্রামের দিন হয়ে দেখা দিয়েছে।’ স্বৈরশাসক আইয়ুবের পদত্যাগ, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ সব রাজনৈতিক বন্দির নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে সরকারের উদ্দেশে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিই। সেদিনই এক বেতার ভাষণে আইয়ুব খান বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে আমি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হব না এবং আমার এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ও অপরিবর্তনীয়।’ এরপর আগরতলা মামলা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তির ঘোষণা দেওয়া হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি সব রাজবন্দির মুক্তির পর বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের গণসংবর্ধনায় ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে সভাপতির বক্তৃতায় প্রিয় নেতাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে বলেছিলাম, ‘যে নেতা তাঁর যৌবন কাটিয়েছেন কারাগার থেকে কারাগারে। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে যিনি বাংলার মুক্তির কথা বলেছেন। যে নেতা বলেছেন, আমি ক্ষুদিরামের বাংলার মুজিব; আমি সূর্যসেনের বাংলার মুজিব; প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভ যার কাছে তুচ্ছ; যে নেতা বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে দ্বিধাবোধ করেননি; হে প্রিয় নেতা বাংলার মানুষ তোমার কাছে ঋণী, চিরঋণী। বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে তুমি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে কখনই মাথা নত করোনি। তোমার সেই ঋণ আমরা কোনো দিন শোধ করতে পারব না। সেই ঋণের বোঝাটাকে একটু হালকা করার জন্য জাতির পক্ষ থেকে তোমাকে একটি উপাধি দিতে চাই।’ ১০ লাখ মানুষ ২০ লাখ হাত উত্তোলন করে কৃতজ্ঞচিত্তে মুক্ত মানব শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করে।

পঞ্চাশের দশক থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের লক্ষ্যে গড়ে তোলা সব আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগ। প্রতিষ্ঠাকালীন ছাত্রলীগের আদর্শ-উদ্দেশ্য ছিল বাংলার মানুষের রাজনৈতিক অধিকার ‘প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকার’-এর দাবি। ’৬৯-এর মহান গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা তা অর্জন করি। আমাদের অর্জিত সাফল্যের পথ ধরেই ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন ও ’৭১-এর মহত্তর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি হয়। ’৭০-এর নির্বাচনে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা এবং ছাত্রসমাজের ১১ দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করে। ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথ গ্রহণ করান স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন ও শাসনতন্ত্র তৈরি করার জন্য অধিবেশনে মিলিত হতে না দিয়ে ’৭১-এর ১ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে পূর্বঘোষিত ৩ মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাত্র নেতৃবৃন্দকে ডেকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেন। নেতার নির্দেশে ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। একমাত্র ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দই সব ধরনের ঝুঁকির মধ্যে এ সিদ্ধান্ত নেন। ২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয় এবং তাঁর নির্দেশে কলাভবনে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলিত হয়। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পল্টনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হয়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন স্বাধীনতার অমোঘ মন্ত্র, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আর ৮ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের রক্তঝরা দিনগুলোয় বঙ্গবন্ধুর সর্বমোট ৩৫টি ঐতিহাসিক নির্দেশাবলি প্রতিটি বাঙালির কাছে হয়ে উঠেছিল অবশ্যপালনীয় অলঙ্ঘ্য বিধান। এরপর ২৫ মার্চ কালরাতে নজিরবিহীন গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের সাবেক ও তৎকালীন নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘মুজিব বাহিনী’ তথা বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট সংক্ষেপে বিএলএফ। মুজিব বাহিনী গঠন করে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে ৩০ লাখ প্রাণ আর ২ লাখ মা-বোনের সুমহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা বিজয় অর্জন করি।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ।

Email : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর