জগন্নাথে বিশ্বজিৎ, বুয়েটে আবরার, জাহাঙ্গীরনগরে শামীম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জলের খুনের দায় মূলত গোটা জাতির। কারণ, আমরা আমাদের মেধাবী সন্তানদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস ক্যাডার বানাতে সর্বশ্রম ও সামর্থ্য উৎসর্গ করেছি- কিন্তু ওদের মানুষ করতে ততটা সচেষ্ট হইনি। মানুষ করতে পারিনি। সৎ পথে চলব, সত্য কথা বলব- এখন বোকাদের দর্শন! তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে একজন সতীর্থকে, একজন সমবয়সিকে সাপ পেটানোর মতো পিটিয়ে মারতে ওদের হাত-বুক কাঁপবে- হৃদয়ের সে কোমলতা ভোঁতা করে দিয়েছি জিপিএ ফাইভ, গোল্ডেন ফাইভের পেছনে ইঁদুর দৌড় ছুটিয়ে। আর ওদের কসাই বানিয়েছে নষ্ট রাজনীতির ভ্রষ্ট নেতৃত্বের দুর্বৃত্তায়ন। তারই বিধ্বংসী পরিণতি বিশ্বজিৎ থেকে তোফাজ্জলের নির্মমতম নির্যাতনের শিকার হয়ে খুব কষ্টের মৃত্যু। একই সঙ্গে খুনিদের সম্ভাব্য উজ্জ্বল ক্যারিয়ারেরও অপমৃত্যু। এসব দুঃখের প্যাচালই আজ পাড়ব ভগ্নহৃদয়ে।
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড-খ্যাত, শতবর্ষ পেরোনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঐতিহ্যবাহী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একই দিনে (বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর) দুই তরুণকে পিটিয়ে হত্যার মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল। ঢাবির ফজলুল হক হলে চোর সন্দেহে দানবীয় নির্যাতনে এক তরুণকে হত্যা করে একদল শিক্ষার্থী। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক ছাত্রনেতাকে কয়েক দফা পিটিয়ে খুন করা হয়। দেশের সব বিবেকবান মানুষ এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে মর্মাহত, হতবিহ্বল, শোকস্তব্ধ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেধাবী তরুণদের এমন জল্লাদ রূপ দেখে অভিভাবক ও প্রবীণ নাগরিকরা শোকাতুর। অনেকেই প্রকাশ্যে চোখের পানি ফেলেছেন। কেউ মন্তব্য করেছেন ‘জাতির আত্মার অপমৃত্যু হয়েছে। এ তো পশুত্বেরও সীমা লঙ্ঘন!’। সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়ায় মুহূর্তে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জল হত্যার ঘটনায় আট শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ছয়জন হত্যার দায় স্বীকারও করেছে। পরে হলের প্রভোস্টসহ ১৫ জনের নামে মামলা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়কসহ আটজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা সেদিন বলেন, খুনিদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। উপদেষ্টা নাহিদ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, শিক্ষার্থীদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ ঘোষণা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ৩৩ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবও যে পশুত্বের কতটা নিম্নস্তরে নামতে পারে, তার কিছু সংক্ষিপ্ত নজির এখানে তুলে ধরছি-
তোফাজ্জল হত্যা : ছয়টি মোবাইল ফোন সেট এবং চারজনের মানিব্যাগ হারানোর বিষয় সামনে রেখে ঘটনার শুরু। ঢাবির ফজলুল হক মুসলিম হলে একটা টুর্নামেন্ট চলছিল। বুধবার দুপুরে সেখানে অংশগ্রহণকারীদের ছয়টি মোবাইল ফোন ও চারজনের মানিব্যাগ একটা ব্যাগে ভরে কমেন্ট্রি বক্সের পাশে রাখা হয়। ব্যাগটি চুরি হয়ে যায়। এ ব্যাপারে সন্ধ্যায় শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। রাত ৮টার দিকে তোফাজ্জল হোসেন নামের এক যুবক ওই মাঠে ঢুকলে চোর সন্দেহে তাকে ধরে হলের অতিথি কক্ষে নিয়ে যায় শিক্ষার্থীরা। জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে নিজেদের ক্ষুধা পেলে মানবতা উথলে ওঠে খুনিদেরও। তোফাজ্জলকেও হলের ক্যান্টিনে নিয়ে রাতের খাবার খাওয়ানো হয়। সে কি জানত, এই তার জীবনের শেষ খাওয়া! এরপর আরেকটি কক্ষে নিয়ে আবার প্রাণঘাতী মারধর। এর মধ্যে নির্যাতন কক্ষে একবার এসেছিলেন প্রভোস্ট। কিন্তু তিনি তোফাজ্জলকে উদ্ধার না করেই ফিরে যান। রাত ১২টার পর কয়েকজন শিক্ষার্থী তোফাজ্জলকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। রাত ১টার দিকে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
জাবির শামীম : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বেধড়ক মারধরে নিহত শামীম আহমেদ বা শামীম মোল্লা এক সময় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। বুধবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের জয়বাংলা ফটকের সামনে কারও জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় তিনজন তাকে আচমকা মারধর শুরু করে। একপর্যায়ে ক্যাম্পাসের ভিতরে টেনে নিয়ে আরও কয়েকজন মিলে পেটাতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল শাখার কর্মকর্তারা তাকে উদ্ধার করে প্রক্টর কার্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার করিডরে নিয়ে যান। সেখানে গেটে তালা দিয়ে রাখা হয়। কিছুক্ষণ পর তালা ভেঙে সেখানে গিয়ে আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী শামীমকে আবারও মারধর করে। প্রকাশিত খবরে জানা যায়, এরা ছাত্রদলের নেতা-কর্মী। রাত ৮টার দিকে প্রক্টরিয়াল টিম গুরুতর আহত শামীমকে আশুলিয়া থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। কেন, সে কি কোনো অপরাধ করেছিল? সংঘবদ্ধ ঘাতকদের হাতে অসহায়ভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়া কি তার অপরাধ ছিল? হাসপাতালে না নিয়ে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হলো কেন? পুলিশ তাকে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক যথারীতি মৃত ঘোষণা করেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, যেগুলো জনগণের টাকায় চলে, নামমাত্র বেতনে যেখানে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায় শিক্ষার্থীরা- এগুলো কি দানব তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে? যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-দর্শন-শিল্প, সত্য-সুন্দরের চর্চা ও সাধনা হওয়ার কথা, সেখানে সুকুমার তারুণ্যকে খুনি-কসাই করে তোলার নেপথ্য কারিগর, কুশীলব কারা? এত বড় অধঃপতন কেন দেখতে হচ্ছে জাতিকে?
মব জাস্টিস মানে উত্তেজিত জনতার বিচার। এটা কখনো সুবিচার হতে পারে না। আইন হাতে তুলে নেওয়ার এ অন্যায় প্রবণতা শক্ত হাতে ঠেকাতে হবে।
বিশ্বজিৎ থেকে আবরার, তোফাজ্জল আর শামীম মোল্লা- এদের পিটিয়ে মারা শুধু মর্মান্তিক নয়, চূড়ান্ত অমানবিক। বিশ্বজিৎ ও আবরারের দুর্ভাগ্যের নান্দীপাঠ এ পর্যায়ে স্থগিত রেখে তোফাজ্জল ও শামীমের কথা বলি। এদের নির্মম হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের অবিলম্বে দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে। আর তার ভুল বার্তা যাবে জনমনে। উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপার মতো অভিযোগের তীর ছুটবে অন্তর্বর্তী সরকার এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের ওপর। তাদের সাফল্য-ব্যর্থতার প্রশ্ন উঠবে। ঢাকা এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন দুই তরুণের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছিল, তখন উপস্থিত কোনো শিক্ষার্থী অথবা কর্তৃপক্ষ কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে পারতেন না? তারা চরমভাবে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। একজন মানুষকে পিটিয়ে মারা সহজ কথা নয়। খুব অল্প সময়েও তা সম্ভব হয় না। অথচ এই হত্যাযজ্ঞ একদল চালালো, মশকরা করে তোফাজ্জলকে শেষ ভাতও খাওয়ালো- কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশে এমন কেউ থাকল না প্রতিবাদ করে বাধা দেওয়ার অথবা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বজায় রেখেই, দূর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোর? এ হত্যার দায় সবার। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী, শিক্ষক, প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় থানা পুলিশের। দুর্ভাগ্য গোটা জাতির। যে তেজোদীপ্ত তারুণ্য মাত্র ছত্রিশ দিনের আন্দোলনে দেড় দশকের স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটিয়ে দ্বিতীয় বিজয় অর্জন করল, সোনালি ইতিহাস রচনা করল স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় মর্যাদা পুনরুদ্ধারের। এর মাত্র কদিন পর গুটিকয় নরকের কীটের হাতে অবর্ণনীয় নির্যাতনে ঝরে গেল দুটি তাজা তরুণের প্রাণ। খুব দ্রুত খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বাস্তবায়ন না হলে এমন ঘটনা বন্ধ হবে না। সরকারকে সেই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। দ্রুত বিচার, দ্রুততম কার্যকর প্রত্যাশা করে জাতি।
বিশ্বজিৎ : সেই রোগা ছেলেটি : প্রায় এক যুগ আগে, ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর রাজধানীর পুরান ঢাকায়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এক যুবককে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে একদল যুবক। নিহত হতভাগ্যের নাম বিশ্বজিৎ দাস। বিনাদোষে, প্রকাশ্যে দিবালোকে, শত শত মানুষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং বেশকটি সংবাদ মাধ্যমের ক্যামেরা ও কর্মীদের সামনে নৃশংসতম এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। সেদিন রাজধানীতে সরকারবিরোধী আন্দোলন চলছিল। পেশায় দর্জি, পঁচিশ বছরের যুবক বিশ্বজিৎ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দিয়ে হেঁটে পার হওয়ার সময় সরকারপন্থিরা হঠাৎই তাকে কিল-ঘুসি-লাথি মারতে থাকে। কেউ এসে লোহার রড দিয়ে পেটায়। তাতেও থামে না জিঘাংসা। চাপাতি দিয়ে উপর্যুপরি কোপানো হয় বিশ্বজিৎকে। ও বারবারই দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেছিল, দুর্বৃত্তরা তাড়া করে ধরে তাকে আবার পেটায়, কোপায়। একপর্যায়ে অচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে খুনিরা বীরদর্পে স্থান ত্যাগ করে। সেভাবেই অনেকক্ষণ পড়েছিল ছেলেটি। শরীরের প্রায় সব রক্ত বেরিয়ে গেলে দ্রুতই মৃত্যু হয় তাজা তরুণের। বিশ্বজয় করার স্বপ্নে বাবা-মা যার নাম রেখেছিলেন বিশ্বজিৎ, জীবন উদযাপনের আগেই হেরে গেল নরপশুদের পৈশাচিক উন্মাদনায়। সেদিন যত মানুষ এই দানবীর হত্যাযজ্ঞ খুব কাছ থেকে দেখেছে, ক্যামেরায় ছবি তুলেছে, ভিডিও ধারণ করেছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাছেপিঠে ছিল, সবাই এগিয়ে এসে যদি মানবঢাল রচনা করত, ঘাতকদের বাধা দিত, অন্তত সবাই মিলে যদি উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার শুরু করত- দুর্বৃত্তরা হয়তো থমকে যেত। প্রাণ বাঁচত বিশ্বজিতের। টিভি কোম্পানির যে সংবাদকর্মীরা ঘটনার ভিডিও ধারণ করছিলেন, তাদের কোনো গাড়িতে যদি দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হতো- চিকিৎসকরা চেষ্টা করে দেখতে পারতেন ছেলেটিকে বাঁচানো যায় কি না। দুর্ভাগ্য, এসবের কিছুই করা হয়নি। একজন রিকশাচালক তাকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যান। তখন আর সে নেই। কারও কিছু করার ছিল না। হত্যাকারীরা প্রায় সবাই ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য টেলিভিশনে প্রচারের পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে গোটা জাতি। বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার অনেক বিচার হয়েছে। অনেক রকম রায় হয়েছে। ফলাফল হচ্ছে- পাঁচ বছর পর নিহত যুবকের ভাই উত্তম দাস চরম হতাশা প্রকাশ করেন। বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে।
বুয়েটের আবরার ফাহাদ : খুব মেধাবী শিক্ষার্থীরাই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পড়ার সুযোগ পান। সমকালে এদের জাতির শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী বললে বেশি বলা হয় না। তেমনই এক তরুণের নাম আবরার ফাহাদ। তিনি ত্রিপল-ই বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তখন। কুষ্টিয়ায় আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত পরিবারের সন্তান আবরার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজেও ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন। মেডিকেলে কিছুদিন ক্লাস করেও বাদ দিয়ে প্রকৌশলী হতে এসেছিলেন বুয়েটে।
২০১৯-এর ৭ অক্টোবর। কুষ্টিয়ার বাড়ি থেকে হলে ফেরেন আবরার। শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর রুমে থাকতেন তিনি। সেখানেই ছিলেন। রাত ৮টার দিকে আবরারকে দোতলার ২০১১ নম্বর রুমে ডেকে পাঠান তৃতীয় বর্ষে পড়া কয়েকজন শিক্ষার্থী। তারা ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে আবরারকে বেধড়ক পেটাতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর চতুর্থ বর্ষের কয়েকজন আসেন। তারাও বীভৎস উল্লাসে পেটান আবরারকে। একপর্যায়ে নিথর হয়ে পড়েন আবরার। তখন তাকে দোতলা ও নিচতলার সিঁড়ির মাঝামাঝি নিয়ে ফেলে রাখা হয়। রণক্লান্ত নির্যাতনকারীরা রাতের খাবার খেতে যান। পড়ে থাকে আবরারের মৃতদেহ। রাত ৩টার দিকে হলের প্রাধ্যক্ষ দয়া করে খবর পান! কষ্ট করে বুয়েটের চিকিৎসক ডেকে পরীক্ষা করানো হয়! তিনি ফলাফল ঘোষণা করেন। ‘সে আর বেঁচে নেই’। আবরারের হত্যাকারীরাও সবাই বুয়েট ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ছিলেন। তাদের ভাষায়, আবরারের অপরাধ ছিল- সে ওই সময় বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পাদিত কিছু চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল। এর জন্য তাকে অমানুষিক নির্যাতনে জীবন দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে। প্রতিবাদে অনেক আন্দোলন, বিক্ষোভ হয়েছিল। কদিন পর সেসব থিতিয়েও যায়। জীবন চলতে থাকে বহতা নদীর মতো। কিন্তু সন্তান হারানো মায়ের চোখের জল কোনো দিন শুকোবে না। পিতার দীর্ঘশ্বাস তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ পর্যন্তই থাকবে। আদরের বোনটি পাবে না ভাইয়ের স্নেহ। পরিবারে ছেলেটির শূন্যতা পূরণ হবে না কোনো দিন।
রাবির মাসুদ : ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল সকালে ক্লাসে যাওয়ার পথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জিয়া হলের সামনে হামলার শিকার হন আবদুল্লাহ আল মাসুদ। তিনি রাবি ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ওই হামলায় মাসুদের ডান পায়ের গোড়ালির অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পড়া শেষ করে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্টোরে চাকরি করছিলেন। গত ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় অজ্ঞাত লোকজন তাকে মতিহার থানা এলাকার অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে মারধর করে। উত্তেজিত জনতা একপর্যায়ে তাকে থানায় নিয়ে আসে। তখন তার মুমূর্ষু অবস্থা। রাত ১২টার দিকে পুলিশ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তথাকথিত ‘মব জাস্টিস’-এর শিকার মাসুদ। যার অর্থ উত্তেজিত জনতার বিচার। এ বিচার কখনো ন্যায়বিচার হতে পারে না। আইন হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কেউ কাউকে দেয়নি। সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জড়িত সবার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা রুজু করে দ্রুত বিচার শুরু করা দরকার।
ঢাবির সাত খুন : স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ক্যাম্পাসে প্রথম রক্তবন্যা বয়েছিল ১৯৭৪-এ। ৪ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হলে সাত ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঢাবিতে সাত খুন নামে পরিচিত এই খুনে জড়িত বলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তা কার্যকর করা হয়নি। আর হয়নি বলেই, নিকট অতীত ঘাঁটলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন, লাঞ্ছনার অনেক তথ্যই উঠে আসবে- এ নিবন্ধে সে গ্লানির ভার আর বাড়াতে চাই না। বরং কবি জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত কবিতার পঙ্ক্তিটি দিয়ে শেষ করি- ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?’
লেখক : সহকারী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন