স্বাধীনতা কিংবা স্বাধীনতা-উত্তর রাজনীতিতে জামায়াতকে নিয়ে বিতর্ক বা সমালোচনা থেমে থাকেনি। ঘটনাচক্র, কর্মকান্ড, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, নীতি-আদর্শ, সাংগঠনিক কর্মকান্ড সবই এসেছে আলোচনা ও সমালোচনায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরকার গঠনে জামায়াতকে অক্ষ ও মিত্রশক্তি হতেও দেখা গেছে। দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর বন্ধু হয়েও কালক্রমে চরম শত্রুতেও পরিণত হয়েছে দলটি। প্রশ্ন হলো- শুধু দল হিসেবে জামায়াতকে নিয়েই সমালোচনা হয়? আসলে ইতিহাস কিন্তু তা বলছে না। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ বাম ও ডানপন্থি অন্যান্য দলকে নিয়েও বিভিন্ন ইস্যুতে বিতর্ক ও সমালোচনা রয়েছে। আর এসব সমালোচনার কেন্দ্রেই সরকার পরিচালনা, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, স্বার্থপরতা, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, কূটনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয় রয়েছে।
প্রচলিত রাজনীতিতে অন্যান্য দলের তুলনায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে কেন এত বিতর্ক বা সমালোচনা। এসবের মানদন্ডই বা কী? অন্য কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ডের সঙ্গে তুলনা করলে কি সমালোচনা করার ইস্যু জামায়াতের দিকেই ঝুঁকে, নাকি একপেশে করা হয়? সেই প্রশ্নও এ সময়ে উঠছে। একটু বর্তমান থেকে অতীত ঘটনাপ্রবাহের দিকে আলোকপাত করলে বিষয়টির সবক পাওয়া যাবে।
১. আওয়ামী লীগের পতন আন্দোলন : বিগত এক দশক ধরে বিএনপিসহ বিরোধী সব রাজনৈতিক দল নানা ফর্মুলায় সরকার পতনের আন্দোলন করে আসছিল। হরতাল- অবরোধ, ২০১৩ সালে মার্চ ফর ডেমোক্রেসি, অসহযোগ, গণ অনশন, এক দফা সবই করা হয়েছে। এর সবগুলোতেই জামায়াত অংশগ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার যখন বিরোধী দলে ছিল তখনো জামায়াতের সঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলন করেছে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দলগুলোর মধ্যে আসলে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। ঘটনাপ্রবাহ যাই থাক তার দায় সব দলেরই থাকবে। জামায়াত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দাবি আদায়ের চেষ্টা করেছে। তবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যেভাবে টেইলার্স শ্রমিক বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করেছে জামায়াত সেই পথে হেঁটেছে বলে এমন কোনো প্রমাণ গণমাধ্যম তুলে ধরতে পারেনি অদ্যাবধি। আর জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরকে নিয়ে ‘রগ কাটার’ যে প্রচারণা চালানো হয় সে বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করেই চলতি বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর জবাব দিয়েছেন সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি এস এম ফরহাদ। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘সহজ করে বললে রগ কাটা লিখে গুগলে সার্চ করলে দেখবেন সব ক্রাইমে ছাত্রলীগের নাম। শিবিরের নামে কোনো ডকুমেন্ট পাবেন না। ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে শিবিরের নামে নানা ধরনের ট্যাগ দেয় আওয়ামী লীগ।’
২. জুলাই বিপ্লব : বিপ্লব সাধারণ সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। কোনো প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে বা শক্তিকে হটিয়ে দিয়ে নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তন বা কায়েম করাই হলো বিপ্লব। এতে দল-মত, শ্রেণি-পেশার কোনো স্বতন্ত্র পরিচয় বহন করে না। লক্ষ্য এক ও অভিন্ন থাকে সবার। জুলাই বিপ্লবটি এমনই একটি ঘটনা। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের জন্য সব মতাদর্শের ছাত্র, বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে নেমেছিল। নেতৃত্ব কে দিল তা মুখ্য ছিল না। তার পরিচয় তুলে ধরারও গুরুত্ব বহন করেনি। বরং সামগ্রিক ঐকমত্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো পরিস্থিতির পরিবর্তনের পর জুলাই বিপ্লবের সমন্বয়কদের মধ্যে ছাত্রশিবিরের নেতার পরিচয় প্রকাশের পর সমালোচনা শুরু করে একটি মহল। কারণ যারা সমালোচনা করছেন তারা আন্দোলনে যুক্ত হয়ে থাকলে অবশ্যই নিজেদের ব্যক্তিসত্তা, চিন্তা, মননকে বিসর্জন দেননি, উচিতও নয়, বরং তুলে ধরা দরকার। তারা নিশ্চয়ই নিজের পরিচয়কে ধারণ করেই এখনো আছেন, তাহলে কেউ শিবির করলে দোষ কেন? প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী জাতির আকাক্সক্ষাকে যারা মূল্য দেবে, ত্যাগ স্বীকার করবে তারাই নেতৃত্ব পাবে। জাতির প্রয়োজনে ঐক্যের ভিত গঠন করা এখন জরুরি মনে করে জামায়াত নেতৃত্ব সেই বক্তব্যই দিচ্ছেন।
৩. দ্বন্দ্ব ও আগ্রাসন নিয়ে জামায়াতের কর্মকান্ডের বিতর্ক করছেন অনেকে। গত ৯ অক্টোবর জামায়াত তাদের রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরেছে। রাজধানীর গুলশানের পাঁচতারকা হোটেল ওয়েস্টিনে সুধীসমাবেশ করে প্রস্তাবনাগুলো তুলে ধরেছে। প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্ত ৪১টি বিষয়ের মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারসহ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ সমুন্নত রাখার ওপর গুরুত্ব তুলে ধরেছে। বুর্জোয়া প্রসঙ্গে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছিলেন, একটি বুর্জোয়া দল হওয়ার জন্য প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হতে হয়। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে চায় না। বুর্জোয়ারা দেশের সম্পদ কুক্ষিগত করে নিজের পকেটে ঢুকাতে চায়। এগুলো জামায়াতের মাঝে নেই, বরং জনগণের সঙ্গে মিশে ও মানুষের বিপদে সহযোগিতা ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে কল্যাণে কাজ করে।
সম্প্রতি শারদীয় দুর্গাপূজার মন্ডপে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা নিয়ে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরকে জড়িয়ে সমালোচনা হচ্ছে। যে কোনো নতুন বিষয় নিয়ে সমালোচনা বা পুরাতনের সঙ্গে দ্বান্দ্বিক মনে হওয়া স্বাভাবিক। তবে পরিমাপের নিক্তি বা মূল্যায়নের প্রাসঙ্গিকতা ঠিক থাকলে হয়তো বিতর্কের সহজ সমাধান হতে পারে। সব দল বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বলে বক্তব্য দেয়। অতীতের চেয়ে সনাতনীদের পূজা বা ধর্মাচালে জামায়াতের নিরাপত্তা দেওয়া বা খোঁজখবর নেওয়ার তৎপরতা এবার বেশি ছিল। যার কারণে সাংস্কৃতিক মঞ্চে দেশাত্মবোধক ভাবধারার গান পরিবেশনার আমন্ত্রণ জানায় চট্টগ্রামের একটি মন্ডপ কর্তৃপক্ষ। এটি কোনো আগ্রাসন নয়, বরং সম্প্রীতির উন্নয়নের বহিঃপ্রকাশ। তবে আদর্শিক দিক থেকে ভিন্নতার কারণে স্বার্থান্বেষী শ্রেণির সমালোচকরা ‘টপিক আউট’ করে ভাইরাল করেছে বিষয়টিকে- যা হীন উদ্দেশ্যের প্রকাশ।
দলটির বিরুদ্ধে নেতিবাচক বয়ান তৈরির প্রকল্প দীর্ঘদিনের। এর ফলও ভোগ করেছে দুভাবে স্বার্থান্বেষীরা। একটি হলো জামায়াত-বিদ্বেষ সমাজে জিইয়ে রাখা, আরেকটি হলো দলটির নেতা-কর্মীদের কোণঠাসা করে রেখে নিজেদের অপকর্মগুলোকে আড়াল করা এবং পরিধি বাড়িয়ে ভোগবাদী মানসকে প্রতিষ্ঠা করা। তবে সম্প্রতি জামায়াত যেভাবে গণমানুষের কাছে সমাজ ভাবনা ও বাস্তব পরিস্থিতির মেসেজ পৌঁছে দিয়েছে, তাতে করে বয়ান প্রকল্পবিদদের স্বপ্নবিলাস ধ্বংস হয়েছে। নবজাগরণে মসনদ উল্টে গেছে। তবে ফ্যাসিস্টের দোসর ও ক্রীড়নকরা নানাভাবে ছোবল দেওয়ার চেষ্টায় সক্রিয়।
প্রেক্ষাপট ও উদ্ভূত পরিস্থিতিও কাউকে মূল্যায়নের একটি নিক্তি হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান আকাক্সক্ষাকে কোন দল কীভাবে ধারণ করছে তা আলোচনার দাবি রাখে। বর্তমান সরকার যে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে এতে বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যান্য দল নানা প্রস্তাবনা ও পরামর্শ দিয়েছে। সবার লক্ষ্য হলো কল্যাণকর শাসনের পথ সুগম করা। ভবিষ্যৎ ফ্যাসিবাদের পথ রুদ্ধ করা ও ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করার মতো প্রস্তাব জামায়াত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে দিয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো- পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনব্যবস্থা। তবে বার্তা সংস্থা ইউএনবিতে দেওয়া এক মতামতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তারা নির্বাচনে পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব প্রক্রিয়ায় নির্বাচন চান না। তবে ভবিষ্যৎ ফ্যাসিস্টের পথ রুদ্ধ করা বা ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য পিআর পদ্ধতিকে অধিক কার্যকরী মনে করেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ।
যে কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতি এবং কর্মকান্ড জনবান্ধব ও সময়োপযোগী হতে হবে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে জনকল্যাণে পরিচালিত করার জন্য ক্ষমতাসীনদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা গড়ে ওঠে রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে। অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কখনো টিকে থাকা যায় না কিংবা ফলপ্রসূ কাজও করা যায় না। সমালোচনা পথ বাতলে দেয়, আর সমালোচনাকে রুদ্ধ করে দিলে চলার পথ খাটো হয়ে যায়- পতন হয়। এজন্য রাজনীতির সৌন্দর্য হলো যৌক্তিক সমালোচনা। কথায় আছে যুক্তিতে মুক্তি মেলে, তর্কে বহুদূর।
লেখক : গবেষক