উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র থাকা অবস্থায় রবার্ট ব্রাউনিংয়ের ‘দ্য প্যাট্রিয়ট’ কবিতাটি পড়েছিলাম। তাঁর এ বিখ্যাত কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৫৫ সালে। কবিতাটি মূলত একজন শাসকের উত্থান-পতনের বর্ণনা; যিনি একসময় তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। দেশের মানুষ তাঁকে সাদরে বরণ করে নিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পরিণত হন জনগণের কাছে পরিত্যাজ্য এক মানুষে। বলা যায়, কবিতাটি একজন শাসকের জীবনের পরিহাসের চিত্রাঙ্কন। রবার্ট ব্রাউনিং তাঁর কবিতায় যে প্যাট্রিয়টের কথা বর্ণনা করেছেন- তিনি যেদিন রাজধানীতে প্রবেশ করেন, রাস্তা ছিল কুসুমাস্তীর্ণ। পথের দুই ধারে দাঁড়িয়ে হর্ষোৎফুল্ল জনতা তাঁকে অভিবাদন জানাচ্ছিল। দুই পাশের বাড়িগুলোর জানালা-ছাদ থেকে তাঁর মাথার ওপর হচ্ছিল পুষ্পবৃষ্টি। কিন্তু মাত্র এক বছরের মাথায় জনগণ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। যেদিন মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার জন্য তাঁকে দড়ি দিয়ে পেছনে হাত বেঁধে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন তিনি যা ভাবছিলেন কবি ব্রাউনিং তা তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘পুরোটা পথ ছিল গোলাপের সমারোহ,/গুল্মলতা যেন উন্মাদের মতো আমার পথে মিশেছিল,/ঘরের ছাদগুলো দুলছিল, উঠছিল-নামছিল,/গির্জার চূড়াগুলো জ্বলজ্বল করছিল,/পতাকাগুলো এত উজ্জ্বল ছিল,/এক বছর আগে ঠিক এই দিনে।’ এরপর শেষ দিনের দৃশ্য উঠে এসেছে এভাবে- ‘এখন আর কেউ নেই ছাদে,/শুধু কয়েকজন অশক্ত মানুষ জানালার পাশে,/বসে আছে,/সবাই জানে, সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্যটি,/কসাইখানার গেটের কাছে- বা, আরও ভালো,/ প্রাণদন্ডের মঞ্চের পায়ের কাছে আমি মনে করি।’ একেবারে শেষে প্যাট্রিয়ট বলেছেন, ‘এইভাবে প্রবেশ করেছিলাম, আর এইভাবে যাচ্ছি!’
আজ থেকে ১৬৯ বছর আগে কবি রবার্ট ব্রাউনিং একজন শাসকের গৌরবময় আগমন ও করুণ প্রস্থানের যে চিত্র এঁকে গেছেন, যুগে যুগে সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। দেখা গেছে, জনগণ এক দিন যাকে নায়কের মতো বরণ করেছে, সময়ের ব্যবধানে তারাই আবার তাঁকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে আঁস্তাকুড়ে। বস্তুত রাজনৈতিক মঞ্চে সবার প্রবেশ ও প্রস্থান সমানভাবে হয় না। জনগণের জিন্দাবাদ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে যার প্রবেশ ঘটে, সময়ের ব্যবধানে হয়তো তার প্রস্থান ঘটে নিন্দাবাদ ধ্বনির মধ্য দিয়ে। কেউ তাঁর জন্য চোখের পানি ফেলে না, ছাড়ে না দীর্ঘশ্বাস। বরং ত্যাগ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস।
এর ঠিক ১০০ বছর পর আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট লেফটেন্যান্ট জুয়ান ডোমিঙ্গো পেরনের জীবনে তাই ঘটেছিল। দুই দফায় তিনবার তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। একবার ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে, আর ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তৃতীয় মেয়াদে। প্রথম মেয়াদে পেরন অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। জনকল্যাণে বেশ কিছু কাজও করেছিলেন তিনি। কিন্তু ক্ষমতাকে সংহত করতে গিয়ে ডোমিঙ্গো পেরন চরম স্বৈরাচারী পন্থা অবলম্বন করেন। ভিন্নমতাবলম্বীদের বরখাস্ত করা, নির্বাসিত করা, গ্রেপ্তার করে জেলে প্রেরণ এবং সংবাদমাধ্যমকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর পেরন নানা সমস্যায় জড়িয়ে পড়েন। কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করতে গিয়ে দেশের অভিজাত শ্রেণি এবং সাধারণ মানুষের বিরাগভাজন হন তিনি। ক্যাথলিক গির্জার যাজকদের সঙ্গে তাঁর চরম বিরোধ বাঁধে। এজন্য তিনি দুজন ক্যাথলিক যাজককে নির্বাসিত করলে জনগণ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ১৯৫৫ সালের জুন মাসে পেরনের সমর্থকরা বুয়েন্স আয়ার্সের প্লাজা ডি মায়োতে বোমা হামলা করে। এতে ৩০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। পেরন সমর্থকরা বেশ কিছু গির্জায়ও হামলা চালান। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। কয়েক মাস পরই এক সফল অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতাচ্যুত এবং দেশত্যাগে বাধ্য হন। আর্জেন্টিনা থেকে বিতাড়িত হয়ে পেরন প্যারাগুয়ে, ভেনেজুয়েলা, পানামা এবং স্পেনে বসবাস করেন। কথিত আছে, ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশত্যাগের আগে তিনি কয়েক টন স্বর্ণ বিদেশে পাচার করেছিলেন। তবে নির্বাসন শেষে পেরন দেশে ফিরে এসেছিলেন। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৭৩ সালে তিনি পুনরায় আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। জুয়ান পেরন তাঁর দল পেরোনিস্ট পার্টির কর্মীদের কাছে মহান নেতা, কিন্তু ইতিহাসে তিনি বিবেচিত স্বৈরশাসক হিসেবেই।
আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট পেরনের উত্থান-পতনের কাহিনি জানা গেলেও কবি রবার্ট ব্রাউনিং তাঁর কবিতার নায়ক প্যাট্রিয়টের পতনের কোনো কারণ বর্ণনা করেননি। তবে পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া অন্যান্য ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়, ওই শাসকও নিশ্চয়ই তাঁর কার্যকলাপের দ্বারা দেশের জনগণের ক্ষোভ উৎপাদন করেছিলেন। যেজন্য এক দিন বীরের মতো তিনি যে পথ দিয়ে প্রবেশ করেছিলেন, সময়ের ব্যবধানে অপরাধী হিসেবে শাস্তি গ্রহণ করতে সেই পথ দিয়েই তাঁকে হেঁটে যেতে হয়েছে মাথা নিচু করে। এখানে সব শাসকের জন্য শিক্ষণীয় হলো- রাষ্ট্রক্ষমতার দন্ডকে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহারের ফল ভালো হয় না। একজন শাসকের স্বৈরশাসকে পরিণত হতে খুব বেশি কিছু দরকার হয় না। লাগে কিছু স্তাবক, তল্পিবাহক ও কুপরামর্শদাতা; যারা সে শাসককে তার ক্ষমতা সংহত করতে জনবিরোধী পদক্ষেপ নিতে প্ররোচিত করে। এজন্যই দেখা যায়, রাষ্ট্রক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার ভ্রান্ত চিন্তায় আজীবন গণতন্ত্রের পূজারি কেউ হয়ে ওঠেন চরম স্বৈরাচারী। যে গণতন্ত্রের জন্য তিনি আজীবন লড়াই করেছেন, সেই গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করতেও তাঁর হাত কাঁপে না। তেমন শাসকদের পরিণতিও হয় রবার্ট ব্রাউনিংয়ের দ্য প্যাট্রিয়টের মতো। একজন রাজনীতিক বা দেশ শাসকের জনপ্রিয়তা অর্জন করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। কিন্তু সেই জনপ্রিয়তা হারাতে সময় লাগে না। তিল তিল করে গড়ে তোলা জনপ্রিয়তার পিরামিড সামান্য একটু ভুলে ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে।
গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বোঝাতে অনেকেই আমেরিকার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের একটি উক্তি উদ্ধৃত করে থাকেন। তবে তা আংশিক। তারা শুধু বলেন, ‘অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল।’ বস্তুত আব্রাহাম লিংকন কথাগুলো বলেছিলেন গণতান্ত্রিক সরকারের রূপ ও পরিণতি সম্পর্কে বোঝাতে। তাঁর বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘দ্য গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, শ্যাল নট প্যারিসড ফ্রম আর্থ’। অর্থাৎ জনগণের সরকার, জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সরকার এবং জনগণের কল্যাণে কাজ করে যে সরকার, সে সরকার কোনো দিন পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে না। আব্রাহাম লিংকন কোনো নির্দিষ্ট সময়ের নির্দিষ্ট সরকারের কথা বলেননি। বলেছেন সব সময়ের সরকারের কথা, যে সরকার জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হবে এবং জনগণের জন্য কাজ করবে। তিনি তাঁর এই উক্তির দ্বারা একটি সরকারের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। যে সরকার জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত নয় কিংবা নির্বাচিত হয়েও জনগণের সরকার হয়ে উঠতে পারে না, জনগণের কল্যাণে কাজ করে না, সে সরকারের স্থায়িত্ব খুব কম। সেটা একটি দেশে যেমন, তেমনি ইতিহাসেও।
আব্রাহাম লিংকন যে ধরনের সরকারের কথা বলেছেন, প্রখ্যাত দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-১৮৭৩) সে সরকারকে বলেছেন ‘উত্তম সরকার’। তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রিপ্রেজেন্টেটিভ গভর্নমেন্ট’ অর্থাৎ ‘জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার’ গ্রন্থে তার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে, যেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ দরবেশ আলী খান অনুবাদ করেছেন এবং বাংলা একাডেমি ১৯৬৯ সালে তা প্রকাশ করেছে। জন স্টুয়ার্ট মিল লিখেছেন- একটি সরকার তখনই উত্তম সরকার হয়ে উঠতে পারে, যখন সেটা জনপ্রতিনিধিত্বমূলক হয়। আর জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সরকার প্রতিষ্ঠায় একটি দেশের জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। সেরকম একটি সরকার প্রতিষ্ঠায় শাসকশ্রেণির পাশাপাশি দেশের জনগণের থাকতে হবে সমান ভূমিকা। তিনি লিখেছেন- ‘ব্যাপক গণপ্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থায় কী সুফল লাভ হবে, যদি নির্বাচকমন্ডলী পার্লামেন্টে সবচেয়ে ভালো সভ্য নির্বাচন করে পাঠাতে যত্নবান না হয়, আর যে নির্বাচিত হওয়ার জন্য কিছু টাকা ব্যয় করে তাকেই ভোট দেয়? কোনো প্রতিনিধিত্বমূলক পরিষদ কী করে কল্যাণের জন্য কাজ করতে পারে, যদি তার সভ্যদের টাকা দিয়ে কেনা যায় এবং যদি তাদের মেজাজ লোকশিক্ষার বা আত্মসংযম দ্বারা সংশোধিত না হয়, আর এত উন্মত্ত হয় যে, সুস্থ চিন্তা বা আলোচনা করতে পারে না, পরিষদ কক্ষে হাতাহাতি, মারামারি করে আর একে অপরকে রাইফেল দিয়ে গুলিও করে?’ এরপর জন স্টুয়ার্ট মিল মন্তব্য করেছেন- ‘যেখানে মানুষের প্রকৃতি হচ্ছে শুধু নিজের স্বার্থসিদ্ধির পথটা দেখা, আর সর্বসাধারণের স্বার্থের বিষয়গুলোতে কোনো আগ্রহ বা চেষ্টা না দেখানো, সেখানে উত্তম সরকার অসম্ভব।’ (পৃষ্ঠা ২৬; বঙ্গানুবাদ দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৮৪)।
আজ থেকে ১৬৪ বছর আগে জন স্টুয়ার্ট মিল যে কথাগুলো বলে গেছেন, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তা কি সাযুজ্যপূর্ণ নয়? জন স্টুয়ার্ট মিলের উত্তম সরকার কিংবা আব্রাহাম লিংকনের পৃথিবীর ইতিহাস থেকে বিলীন না হয়ে যাওয়ার মতো সরকার কি আমরা পেয়েছি? কেন পাইনি তার উত্তর মিলের উক্তির মধ্যেই নিহিত রয়েছে। দেশের নাগরিকরা যদি তাদের দায়িত্ববোধ সম্বন্ধে সচেতন ও সজাগ না হন, তাহলে যে কোনো সরকার ‘অধম সরকারে’ (উত্তমের বিপরীত) পরিণত হওয়া স্বাভাবিক। প্রশ্ন উঠতে পারে আমাদের দেশে নাগরিকদের সেরকম দায়িত্ব পালনের সুযোগ কোথায়? যেখানে ক্ষমতায় আরোহণের পর একটি সরকার তা কুক্ষিগত করার জন্য হেন নিকৃষ্ট পন্থা নেই যা গ্রহণ করে না, জনগণের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করতে এতটুকু দ্বিধা করে না, এমনকি জনগণের ভোটাধিকার হরণ করতেও পিছপা হয় না, সেখানে ইচ্ছা থাকলেও নাগরিকরা কি তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে? এটা যে পারে না, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। বস্তুত এরূপ যারা করে, তারা ইতিহাসে উত্তম সরকারের মর্যাদা পায় না, চিহ্নিত হয় কর্তৃত্ববাদী সরকার হিসেবে। কিছুকাল তারা জনগণকে দাবিয়ে রাখতে পারে। তবে একসময় তাদের জনরোষের মুখে পড়ে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়।
এক্ষেত্রেও আব্রাহাম লিংকন প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, ‘তুমি সব মানুষকে কিছু সময়ের জন্য, আর কিছু মানুষকে সব সময়ের জন্য বোকা বানিয়ে রাখতে পারবে। কিন্তু সব মানুষকে সব সময়ের জন্য বোকা বানিয়ে রাখতে পারবে না।’ শক্তির জোরে জনগণকে স্তব্ধ করে স্বৈরশাসকরা ক্ষমতাকে স্থায়ী করতে চান। কিন্তু একসময় জনগণের চোখ খুলে যায়, তারা সাহসী হয়ে ওঠে। আর তখনই সেই সরকারের ক্ষমতার স্বর্গচ্যুতি ঘটে। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। কিন্তু সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো- ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।
♦ লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক