ছোটবেলা থেকেই আমি সিনেমার পোকা। অভ্যাসটা পরিবার থেকেই হয়েছিল। ষাট দশকের শুরুর দিকে জিন্দাবাহারে থাকতাম আমরা। আব্বা চাকরি করতেন মিউনিসিপ্যালিটিতে। মাসের বেতন পেয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যেতেন। জিন্দাবাহারের কাছেই ইসলামপুর। সেখানে লায়ন সিনেমা হল। সে-ই হলে সিনেমা দেখা হতো। পাটুয়াটুলীতে ছিল ‘মায়া’ সিনেমা হল। যেটা পরে হলো ‘স্টার’। সদরঘাটে ছিল ‘রূপমহল’। এই সব সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন আব্বা। আমার মা-ও সিনেমা-নাটকের খুব ভক্ত ছিলেন। আমরা সবাই একবার বিক্রমপুরে। আব্বা একা ঢাকার বাসায়। আমি বোধ হয় ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়ি। এক মামার সঙ্গে ঢাকায় আব্বার কাছে এসেছি। বিকালে আব্বার একটু কাজ আছে। আমাকে একা কার কাছে রেখে যাবেন? আমরা যে বাসাটায় থাকতাম সে-ই বাসার একটা ছাপরা ঘরে থাকত চিনাবাদামওয়ালা জামির। লায়ন সিনেমা হলের সামনে বসে সে চিনাবাদাম বেচত। ম্যাটিনি শো শুরু হওয়ার আগে বাদামের চাঙারি নিয়ে চলে যেত। নাইট শো শেষ করে ফিরত। আমরা তাকে ‘জামিরকাকা’ ডাকতাম। সেবার আব্বা আমাকে মিডল ক্লাসের একটা টিকিট কেটে লায়ন সিনেমা হলে ঢুকিয়ে দিলেন। ম্যাটিনি শোতে সিনেমা দেখব। জীবনে ওই প্রথম একা একা সিনেমা দেখা। সে-ই ফাঁকে আব্বা তাঁর কাজ সারবেন। শো শেষ হলে হল থেকে বেরিয়ে আমি জামিরকাকার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। সেখান থেকে আব্বা আমাকে বাসায় নিয়ে যাবেন। সে-ই সিনেমাটির নাম এখনো আমার মনে আছে। ‘হনুমান পাতাল বিজয়’। তার পর থেকে গেন্ডারিয়ার জীবন। গেন্ডারিয়া হাইস্কুলে পড়ি। ডিস্ট্রিলারি রোডে যে জায়গাটায় আমাদের বাসা, সে-ই জায়গাটার নাম মুরগিটোলা। প্রায় বস্তিমতো এলাকা। শুধু আমাদের বাড়িটাই একতলা। দুই রুমের পাকা বাড়ি। পাশের বাড়িতে থাকে আলী। একই ক্লাসে পড়ি আমরা। তবে আলাদা আলাদা স্কুল। আমি পড়ি গেন্ডারিয়া হাইস্কুলে, আলী পড়ে কে এল জুবলী স্কুলে। ওই বয়সে আলীর মতো দুরন্ত ছেলে আমি আর দেখিনি। দুরন্ত ও দুঃসাহসী। গভীর বন্ধুত্ব হলো আমার সঙ্গে। আলীর বাবা ছিল সদরঘাট টার্মিনালের কুলিদের সর্দার। ঝুল পকেটওয়ালা শার্ট আর লুঙ্গি পরত। রাতেরবেলা বাড়ি ফিরত ঝুল পকেট ভর্তি খুচরা টাকাপয়সা নিয়ে। কুলিগিরি তাকে করতে হতো না। সর্দার হিসেবে প্রত্যেক কুলির কাছ থেকে বোঝাপ্রতি পয়সা পেত। ’৬৬-৬৭ সালের দিকেই সেই লোকের প্রতিদিনকার আয় ৩০-৪০ টাকা। আলী নির্বিকারচিত্তে তার বাবার টাকা চুরি করত। আমার পকেটে যখন এক পয়সাও থাকে না, আলীর কাছে তখন দু’তিন টাকা, পাঁচ টাকা পর্যন্ত। গেন্ডারিয়ার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে আমাকে নিয়ে খাওয়াত আর সিনেমা দেখাত। তখন এমন হয়েছে, প্রায় রাতেই দুজন একসঙ্গে পড়ব বলে আলীদের বাসায় গিয়ে থাকি। আলীর পড়ার আলাদা ঘর ছিল। সে-ই ঘর গেটের সঙ্গে। চারদিকে চটির বেড়া। মাথার ওপর টিনের চাল। আলীর মা-বাবা, ভাই-বোনও আমাকে খুব ভালোবাসে। সে-ই ঘর বাইরে থেকে শিকল বন্ধ করে আলী আমাকে নিয়ে চলে যেত নাইট শোতে সিনেমা দেখতে। এখন যেমন কোক, ফান্টা বা ¯প্রাইট, তখন ছিল ‘ভিটাকোলা’। এক বোতল চারআনা। সঙ্গে দু’আনার একটা হটপেটিস। ছ’আনায় পেট ভরে যেত। সিনেমা দেখতে গেলেই আলী আমাকে ‘ভিটাকোলা’ আর হটপেটিস খাওয়াত। কত সিনেমা যে ওইভাবে আলীর সঙ্গে দেখেছি! পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ছবি, পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ছবি। জেবা, মোহাম্মদ আলী, দিবা, ওয়াহিদ মুরাদ আর ছিল নীলো। এই মহিলাটি ছিল খুবই যৌন আবেদনময়ী। সে পর্র্দায় এলেই লোকে হাততালি দিত। মেহেদী হাসান, নূরজাহান, মাসুদ রানা, নাহিদ নিয়াজি এই সমস্ত গায়ক-গায়িকার গান থাকত সিনেমায়। রঙিলা নামে একজন কমেডিয়ান ছিল খুবই জনপ্রিয়। তাঁর পর্দায় আসা মানে হাসির হুল্লোড়।
তখন পূর্ব পাকিস্তানেও দারুণ সব সিনেমা হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো নিয়মিত সিনেমা দেখে। সাহিত্যনির্ভর সিনেমা হয় অনেক। চমৎকার গল্প, চমৎকার অভিনয় আর গান। দর্শক মুগ্ধ হয়ে সিনেমা দেখে। ’৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের আগ পর্যন্ত ইন্ডিয়ান ছবিও চলত নিয়মিত। সে বছর সেপ্টেম্বরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়। তার পর পাকিস্তান সরকার ভারতীয় চলচ্চিত্র পূর্ব পাকিস্তানে বন্ধ করে দেয়। তখন বাংলাদেশের রহমান, গোলাম মুস্তাফা, আনোয়ার হোসেন, সুমিতা দেবী, শবনম, তারও কিছু পরে রাজ্জাক, সুচন্দা, সুজাতা, কবরী, তারও পরে ববিতা এসে পূর্ব পাকিস্তানের সিনেমাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। রহমান আর শবনম তখন খুবই জনপ্রিয় জুটি। পরিচালকদের মধ্যে আবদুল জাব্বার খান, সালাহউদ্দীন, কাজী জহির, খান আতাউর রহমান, জহির রায়হান এমন অনেকে নিয়মিত ছবি করছেন। গানের জগতে ফেরদৌসী রহমান, লায়লা আরজুমান্দ বানু, আবদুল জাব্বার, সৈয়দ আবদুল হাদী, নিলুফার ইয়াসমিন, সাবিনা ইয়াসমিন, শাহনাজ রহমতুল্লাহ এরাও জনপ্রিয় হয়েছেন। সব মিলিয়ে বেশ একটা জমজমাট অবস্থা। ষাট দশকেই আমজাদ হোসেন দর্শক মনোযোগ আকর্ষণ করতে লাগলেন। ওই বয়সে আমজাদ হোসেনকে আমরা চিনতাম অভিনেতা হিসেবে। তা-ও কৌতুক অভিনেতা। রুবিনা নামের এক অভিনেত্রীর সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করতেন। কৌতুক অভিনেতা হিসেবে তুমুল জনপ্রিয়। তাঁর একটি সংলাপ তখন মানুষের মুখে মুখে ফিরত। ‘কী বিষয়, বাল্যবন্ধু’? এই সংলাপটি সম্ভবত আমজাদ হোসেনের ‘বাল্যবন্ধু’ সিনেমার। আমি যতদূর জানি, ‘বাল্যবন্ধু’ আমজাদ হোসেন পরিচালিত প্রথম ছবি। কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ সবই তাঁর। তখনো সম্ভবত তিনি জহির রায়হানের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। খান আতাউর রহমানের সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন।
আমজাদ হোসেনের জন্ম জামালপুরে। স্কুলজীবন থেকেই সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নাটকে অভিনয়, লেখালেখি এ সবের শুরু ছেলেবেলাতেই। কঠিন সংগ্রাম করে বড় হওয়া মানুষ। সিনেমার প্রতি ছিল অগাধ টান। সে-ই কারণে জামালপুর ছেড়ে এলেন ঢাকায়। সে সব ষাট দশকের গোড়ার দিককার কথা অথবা পঞ্চাশ দশকের শেষ দিকও হতে পারে। বিটিভিতে এক দিন দেখি আবদুল্লাহ আল মামুনকে তিনি ‘তুমি তুমি’ করে বলছেন। আর মামুনভাই তাঁকে ‘আমজাদভাই আপনি’ করে বলছেন। আমি অবাক! আমজাদভাই তখনো তরুণ-তরতাজা। মাথায় ঘনকালো চুলের একটিও পাকেনি। হাঁটাচলায় তারুণ্য ঝলমল করছে। সে-ই তুলনায় মামুনভাইকে ভারিক্কি ও বয়স্ক মনে হয়। হয়তো বিটিভির উচ্চপদে কাজ করেন বলে মামুনভাই গুরুগম্ভীর ও পদভারে ধীর। কথাটা আমজাদভাইকেই জিজ্ঞেস করলাম। ‘আপনাদের মধ্যে বড় কে?’ উত্তর দিলেন মামুনভাই। ‘বুঝতে পারনি? আমি যে আমজাদভাইকে ‘ভাই ভাই’ করছি তাতেই তো বোঝা যায় তিনি আমার বড়।’ আমজাদভাই হেসে বললেন, ‘আমরা দু’জনেই জামালপুরের লোক। মামুন আমার ছোট।’
চলচ্চিত্র জগতে ঢুকে নানা রকমের কাজ শুরু করেছিলেন আমজাদভাই। একদিকে নামকরা পরিচালকদের সহকারী অন্যদিকে অভিনয়, কাহিনি ও চিত্রনাট্য রচনা। এই করতে করতে চলচ্চিত্রের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অবধারিত হয়ে উঠলেন। প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে লাগলেন। অত্যন্ত পাকা ও নিখুঁত হাতে চমৎকার সব চলচ্চিত্র তৈরি করতে লাগলেন। জহির রায়হানের বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোর সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রের কাহিনি ও চিত্রনাট্য ছিল আমজাদ হোসেনের। ভারি সুন্দর একটা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন খান আতাউর রহমান। তাঁর কণ্ঠে গান ছিল, ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে’? আমার মনে আছে, মাঝে মাঝেই খান আতাউর রহমান হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানটি গাইছেন। কিন্তু একবারও শেষ করতে পারছেন না। এই আরেক গুণী মানুষ ছিলেন আমাদের চলচ্চিত্রে। যেমন অসামান্য অভিনয় করতেন, তেমন গান করতেন আর পরিচালক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। স্বাধীনতার পর তৈরি করেছিলেন ‘আবার তোরা মানুষ হ’। তবে তাঁর তুমুল জনপ্রিয় চলচ্চিত্রটির নাম হচ্ছে ‘সুজন সখী’। খান আতাউর রহমান, জহির রায়হান প্রমুখ বড় বড় পরিচালকের সঙ্গে কাজ করে নিজেকে পাকাপোক্ত করে ফেলেছিলেন আমজাদ হোসেন। আপন মেধার প্রকৃত বিকাশ ঘটাতে পেরেছিলেন। বেশ অনেকগুলো ছবির পরিচালক তিনি। কিন্তু আমার মতো দর্শকের মন জয় করে আছে তাঁর দুটো সিনেমা। ‘নয়নমনি’ ও ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’। এই দুটো চলচ্চিত্রের কোনো তুলনা হয় না। দুটো ছবিতেই নায়ক-নায়িকা ফারুক ও ববিতা। ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’ সিনেমায় অতিগুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রওশন জামিল। আরেক প্রধান চরিত্রে ছিলেন এটিএম শামসুজ্জামান। ‘নয়নমনি’ সিনেমাটা আমজাদ হোসেন তৈরি করেছিলেন তাঁর নিজের লেখা উপন্যাস ‘নিরক্ষর স্বর্গে’ অবলম্বনে। উপন্যাস থেকে সিনেমা বা নাটক তৈরি করতে হলে অনেক কিছুই বদলাতে হয়। আমজাদভাইও বদলেছেন। সে-ই বদলটা খুব জরুরি ছিল সিনেমার জন্য। দুটো সিনেমাতেই যেমন পরিচালকের দক্ষতা ফুটে উঠেছিল, তেমন অভিনয়, তেমন ক্যামেরার কাজ, তেমন গান। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই দুটো সিনেমা চিরকাল তালিকার ওপরের দিকে থাকবে। তাঁর ‘দুই পয়সার আলতা’ চলচ্চিত্রে অসাধারণ একটা গান ছিল। ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই, মানুষ নামের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই। এই মানুষের ভিড়ে আমার সেই মানুষ নাই।’ কী চমৎকার বাণী গানের। আমজাদভাই গানও লিখতেন।
লেখক হিসেবেও আমজাদ হোসেন ছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রচুর গল্প লিখেছেন একসময়। বাংলাদেশের বিখ্যাত সব পত্রিকায় তাঁর গল্প তো ছাপা হয়েছেই, কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকাতেও তাঁর গল্প ছাপা হয়েছে। ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ, কবি ও ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় খুবই পছন্দ করতেন আমজাদভাইকে। শিশু-কিশোরদের লেখাতেও বিশিষ্ট একটি জায়গা আছে আমজাদভাইয়ের। ছোটদের জন্য তাঁর অনেকগুলো বই আছে। ‘আমজাদ হোসেন রচনা সমগ্র’ও বেরিয়েছে। তাঁর একটি মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসের কথা আমার মনে পড়ছে। ‘অবেলায় অসময়’। এই উপন্যাসটি ‘বিচিত্রা’র ঈদসংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। ‘অবেলায় অসময়’ অবলম্বনে তৌকীর আহমেদ ‘জয়যাত্রা’ নামে সিনেমা করেছেন। আমজাদ হোসেনের আরেকটি উপন্যাসের কথা মনে পড়ে। নাম ‘উঠান’। এই উপন্যাস অবলম্বনে বিটিভিতে তিনি একটি ধারাবাহিক নাটক লিখেছিলেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের ফাঁকে ফাঁকে বিটিভির জন্য নাটক লিখতেন তিনি। সেই সব নাটকে অভিনয়ও করতেন। ঈদের বিশেষ নাটক ছিল তাঁর ‘জব্বার আলী’। সেই নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতেন। যেমন লেখা তেমন অভিনয়। হাস্যরসের অফুরন্ত ভান্ডার। তুমুল জনপ্রিয় ছিল আমজাদ হোসেনের ‘জব্বার আলী’। একটি টেলিফোন কোম্পানির বিজ্ঞাপনের মডেল হয়েছিলেন আমজাদভাই। সে-ই বিজ্ঞাপনও তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল। অর্থাৎ যেখানে হাত দিয়েছেন এই শিল্পী সে-ই জায়গাটিকেই আলোকিত করেছেন।
লেখক আমজাদ হোসেনকে আমি একটু অন্যভাবেই পেয়েছিলাম। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়। ‘অনিন্দ্য’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা শুরু করেছিলেন মডার্ন টাইপ ফাউন্ড্রির মালিকের ছেলে নাজমুল হক। নবাবপুরে অফিস। আমজাদ হোসেন, হুমায়ূন আহমেদ, নির্মলেন্দু গুণ ও কয়েক জন তরুণ কবির কাব্যগ্রন্থের পাশাপাশি আমার বই ছাপারও আগ্রহ দেখালেন সেই প্রকাশক। তাঁর অফিসে লেখক কবিদের বেশ একটা আড্ডার জায়গা হয়ে উঠল। দুয়েকদিন পর পরই আমরা সেখানে আড্ডা দিতে যাই। ঘন দুধের চা আর শিঙাড়া খাই। আমজাদভাইও আসেন। আড্ডা জমিয়ে রাখতে তাঁর কোনো তুলনা নেই। এত বড় মানুষ কিন্তু আমাদের সঙ্গে আড্ডায় বসলে শিশু হয়ে যেতেন। হয়তো সে দিন তাঁর শুটিং আছে। শুটিংয়ের কথা ভুলে যেতেন। ‘অনিন্দ্য’ থেকে বেরিয়েছিল তাঁর ‘কাল সকালে’ নামের গল্পগ্রন্থ। হুমায়ূন আহমেদের বেরোল ‘অমানুষ’। আমার ‘কালাকাল’। পরে এই প্রতিষ্ঠান থেকেই বেরিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের ‘এইসব দিনরাত্রি’। বিটিভিতে তাঁর প্রথম তুমুল জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘এইসব দিনরাত্রি’কেই উপন্যাস হিসেবে লিখেছিলেন তিনি। সে-ই বইয়ের সঙ্গে বেরিয়েছিল আমার ‘নির্বাচিত প্রেমের গল্প’। পঁচিশটি প্রেমের গল্পের সংকলন। সে-ই বই হুমায়ূন আহমেদকে উৎসর্গ করা। আমার ‘মধুরাত’ উপন্যাসটি আমজাদভাইকে উৎসর্গ করেছিলাম। বাংলাবাজারেও আড্ডা দিতে যেতেন আমজাদভাই। ‘নওরোজ কিতাবিস্তান’-এ বহু দিন তাঁর আড্ডার সঙ্গী ছিলাম আমি। প্রকাশক ইফতেখার রসুল জর্জ খুবই আপ্যায়ন করতেন আমাদের। সেই সব মধুময় দিনের কথা ভোলা যাবে না।
আমজাদভাইয়ের সঙ্গে তিন-চারটি দিন কাটাবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আশির দশকের শেষ দিকে। তখন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহরে বইমেলার আয়োজন করত ‘জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র’। লেখকদের অতিথি করে নিয়ে যাওয়া হতো। আমজাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমাকে যেতে হয়েছিল চট্টগ্রামে। হোটেলে একই রুম দেওয়া হয়েছে দুজনকে। দুই বিছানায় দুজন মুখোমুখি শুয়ে আমরা গল্প করতাম। আমার খুব আগ্রহ ছিল আমজাদভাইয়ের বৈচিত্র্যময় জীবনের নানান অভিজ্ঞতা শোনার। তিনি এমন চমৎকার ভঙ্গিতে, হাস্যরস আর কৌতুক মিশিয়ে জীবনের গল্পগুলো বলতেন, শুনে আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকি। হাসতে হাসতে মুখ ব্যথা হয়ে যায়। আমজাদভাই তাঁর মতো নির্বিকার গলায় বলে যাচ্ছেন। তখন দুর্গাপূজা চলছে। বইমেলা শেষ করে আমরা হোটেলে ফিরেছি। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ওভাবে শুয়ে শুয়ে আমজাদ ভাইয়ের গল্প শুনছি। পূজার আয়োজক কমিটি কেমন কেমন করে যেন জেনেছে আমজাদ হোসেন এই হোটেলে উঠেছেন। তারা হোটেলে এসে হাজির। রাত তখন ১০টার মতো বাজে। তাদের ইচ্ছা আমজাদভাইকে পূজামণ্ডপে নিয়ে যাবেন। আমজাদভাইয়েরও দেখি বেশ আগ্রহ।
আমাকে বললেন, ‘চলো যাই। অনেক দিন পূজামণ্ডপে যাওয়া হয়নি।’ আমিও তাঁর পিছু ধরলাম। আমজাদ হোসেন গিয়েছেন দেখে বিশাল সাড়া পড়ল মণ্ডপে। আমাদের বসানো হলো সামনের সারিতে। একটি ছেলে ধূপদানি হাতে নাচছিল। দেখে এত উত্তেজিত হলেন আমজাদভাই, হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। সে-ই ছেলের হাত থেকে ধূপদানি নিয়ে এত সুন্দর ভঙ্গিতে নাচতে লাগলেন, দর্শকরা আনন্দে ফেটে পড়ল। আর আমি আছি স্তব্ধ হয়ে। আমজাদভাই এও পারেন! এত সুন্দর নাচ তিনি কোথায় শিখলেন? আসলে আমজাদ হোসেন ছিলেন সর্বান্তকরণে একজন উচ্চমানের শিল্পী। অভিনয়শিল্পীদের সবকিছুই জানতে হয়। তিনি সবই জেনেছিলেন। শিল্পজগতের মানুষের তাঁর প্রতি ভালোবাসা থাকবে চিরকাল।
লেখক : কথাসাহিত্যিক