পবিত্র রমজানুল মোবারক অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সমাগত হলো পবিত্র হজের মাস। শান্তি ও মানবতার ধর্ম ইসলাম। ইসলামের প্রতিটি বিধান মানবতার উজ্জ্বল প্রতীক। ইসলামের স্তম্ভ পাঁচটি। হজ হলো ইসলামের অন্যতম একটি স্তম্ভ। হজ পালন করা মহান আল্লাহর ইবাদত। এতে রয়েছে ইহ ও পরকালের চিরকল্যাণ। রয়েছে সামাজিক রীতিনীতি ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপনের পরম আদর্শ। ঐক্য, সম্প্রীতি ও সৌহার্দপূর্ণ স্বর্গীয় সমাজ প্রতিষ্ঠার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। মহান আল্লাহ কোরআনে কারিমে বলেন, ‘যে লোক হজের প্রতি পূর্ণ নিয়ত করবে, তার জন্য স্ত্রী সহবাস ও আনুষঙ্গিক কিছু জায়েজ নেই। যাবতীয় অশোভন কাজকর্ম এবং ঝগড়াবিবাদ করাও হজ পালনকালে নিষিদ্ধ (বাকারা : ১৯৭)।’ মহানবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ করে, আর সে হজ পালনকালে সে নারী আসক্তি ও যাবতীয় অশুভ কাজকর্ম থেকে বিরত থাকবে ওই ব্যক্তি মায়ের গর্ভ থেকে নিষ্পাপ ভূমিষ্ঠ হওয়ার ন্যায় পাপমুক্তভাবে ফিরে আসবে। (সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম)। বর্তমান বিশ্বে হজের চিত্র হলো লাখ লাখ মানুষের বিশাল সমাবেশ। নারী-পুরুষের অপরিমিত ভিড়, অবর্ণনীয় যানজট সেখানে সার্বক্ষণিক বিষয়। আরাফার ময়দানে অবস্থান, মিনায় পাথর নিক্ষেপ এবং কাবাঘরে তাওয়াফ ও সাফা মারওয়ায় সাঈ মানুষের প্রচণ্ড ভিড় ঠেলেই সম্পন্ন করতে হয়। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে কী অনাবিল শান্তির পরিবেশ। ঝগড়া নেই, বিবাদ নেই, ঠেলাঠেলি-ধাক্কাধাক্কি নেই। নেই অন্যায় উগ্রতা। অবাধ সেই নারী-পুরুষের বিশাল সমাবেশে নারী কেলেঙ্কারি নেই। নেই ইভ টিজিংয়ের মতো সামাজিক কোনো মহামারি।
হজের মাধ্যমে মুমিনগণ আল্লাহ ও রসুলের (সা.) নির্দেশিত ধর্মীয় চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়। বিশ্বের সব অঞ্চলের মুসলমানের অংশগ্রহণে একত্রে ইবাদত-বন্দেগির সুযোগ সৃষ্টি হয়। যা বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব স্থাপনে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। হজ মুসলিম উম্মাহর বর্ণগত, ভাষাগত ও সব ধরনের বৈষম্য দূর করে সৌহর্দপূর্ণ আচরণ শিক্ষা দেয়। হজ পালনকালে পারস্পরিক খোঁজখবর, আদান-প্রদানের সুযোগ হয়। হজের শান্তিপূর্ণ আদর্শ এবং সৌহার্দপূর্ণ শিক্ষা থেকে আমাদের সমাজ আজ দূরে, বহু দূরে। অত্যাচার, মারামারি, হানাহানি, খুন-সন্ত্রাস, হিংসা-বিদ্বেষ আজকের সমাজের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধৈর্য, সহনশীলতা ও সম্প্রীতিপূর্ণ একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের জন্য আমরা হজ পালনের বিধান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। ঐক্য ও সৌহার্দপূর্ণ স্বর্গীয় সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন যারা বুকে ধারণ ও লালন করেন, হজের দৃশ্য তাদের জন্য প্রেরণা ও অনুপ্রেরণার উৎসাহ দেয়। শ্রেণিহীন, বৈষম্যহীন, বিবাদমুক্ত সুখ-শান্তিময় পরিবেশ গড়ার পাথেয় হবে।
হজের পর হাজি সাহেবদের পাপমুক্ত জীবনযাপনই হলো হজ কবুল হওয়ার অন্যতম নিদর্শন। যাদের হজ কবুল হয়েছে, তাদের জীবনের মোড় এবং আমলের অভিযাত্রা ঘুরে যাবে। পাপমুক্ত জীবন গড়ার আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। যত্নবান হবে আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রসুলের আনুগত্যের প্রতি। মহান প্রভু ইরশাদ করেন, ‘আর যখন তোমরা হজের যাবতীয় কাজ সমাপ্ত করবে, তখন স্মরণ করবে আল্লাহকে, যেমন করে তোমরা স্মরণ করতে নিজেদের বাপ দাদাদের (সুরা আল বাকারাহ-২০০)।’
হজের অন্যতম একটি ফরজ কাজ হলো আরাফায় অবস্থান করা। আরাফায় অবস্থান-পরবর্তী রাতে মুযদালিফা নামক স্থানে আল্লাহতায়ালাকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করার প্রতি উল্লিখিত আয়াতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। তবে হজ-পরবর্তী সময়ে আল্লাহতায়ালাকে স্মরণ করা এবং নিয়মিতভাবে তাঁর ইবাদতে মগ্ন থাকার বিষয়ে নির্দেশনা এই আয়াতে রয়েছে, এতে কোনো অস্পষ্টতা নেই। জানার বিষয় হলো, আল্লাহর জিকির বা স্মরণ করা অনেক ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। নামাজ আদায় করা, তাসবিহ পড়া, কোরআন তিলাওয়াত করা ও অন্যান্য ইবাদত করা সবই আল্লাহর জিকিরের অন্তর্ভুক্ত। অতএব কোরআন সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করাই হাজিদের হজ-পরবর্তী প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত। ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবের লোকজন হজ পালন করতেন। কিন্তু তারা পাপাচার বন্ধ করতেন না। তাই আল্লাহতায়ালা জাহেলি যুগের সেই প্রথা পরিবর্তন করার লক্ষ্যে মুসলমানদের হজ-পরবর্তী আল্লার জিকির ও তাঁর ইবাদতে আত্মনিয়োগ করার নির্দেশনা প্রদান করেন।
হজ একটি কঠিন কাজ, আর্থিক ও শারীরিক মহৎ একটি ইবাদত। মহান প্রভু যাকে এই মূল্যবান ইবাদতটি পালন করার তাওফিক প্রদান করেছেন তাদের গর্ব বা অহংকার করার কিছু নেই। আছে শুধু আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করার প্রয়োজন। আল্লাহর প্রশংসা করা, জিকির করা, নিষিদ্ধ কাজ বর্জন করা, মানুষের সঙ্গে সদাচরণ করা, গরিব-মিসকিনদের সহযোগিতা করা, তাদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করা ও নিয়মিত ইবাদত বন্দেগি করা ইত্যাদি আল্লাহতায়ালার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অন্যতম উপায়।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা