সভ্যতার সঙ্গে ভব্যতার সম্পর্ক ওতপ্রোত। ভব্যতাবিহীন সমাজ কখনো সভ্য হতে পারে না। যে সমাজ সভ্য নয়, সেই সমাজকে অসভ্য বলাই বিধেয়। তা সত্ত্বেও কোনো সমাজকে অসভ্য বলা উচিত নয়। যদি বলা হয়, তাহলে সে-ও হয়ে যাবে আরেকটি অসভ্যতা। সভ্যতা আর অসভ্যতার মাঝখানে যে অবস্থা, সেটাকেই বলা যায়, সভ্যতার সংকট। সভ্যতার সংকট নামে রবীন্দ্রনাথের একটা প্রবন্ধও আছে। সেখানে কবি সভ্যতার এই সংকটের তত্ত্ব-তালাশ করেছেন। তবে কোনো মহাজন-মনীষীর উদ্ধৃতি ছাড়াই বলা যায়, যে সময় ও সমাজে সভ্যতা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে, সেই সময় ও সমাজে গণতন্ত্র তার সব রূপ রস ও গন্ধ নিয়ে বিকশিত হয় না। এক হাঁটু কাদার মধ্যে খুব শক্তিশালী মোটরগাড়িও চলতে পারার কথা নয়। তবে যুদ্ধের ট্যাংক মনে হয় কর্দমাক্ত পথেও চলতে পারে। আসলে পারে কি না, জানি না। সমরবিদরা এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। সংকটাপন্ন সভ্যতার সঙ্গে কর্দমাক্ত পথের তুলনা চলতেই পারে।
বিষয়টির ভিতরে প্রবেশ করার আগে ভব্যতা জিনিসটা কী, সে বিষয়ে দুটো কথা বলা বাঞ্ছনীয় মনে করি। অনেকের কাছে শব্দটি অনাধুনিক ও কঠিন বলে মনে হতে পারে। আদতে ‘ভব্যতা’ কোনো কঠিন শব্দ নয়, প্রাচীনও নয়। এটি একটি উৎকৃষ্ট বাংলা শব্দ। ভব শব্দের সঙ্গে যা ফলা যুক্ত হয়ে ভব্য। ভব্য অর্থ সুন্দর, পরিমার্জিত। ভব্যতা অর্থ সদাচার, শিষ্টাচার, ভদ্রতা। কথায় ও কাজে অন্যের সঙ্গে সদাচার বা মার্জিত আচরণের নাম শিষ্টাচার। এই শিষ্টাচারের আরেক নাম ভব্যতা। সমাজ থেকে যখন শিষ্টাচার বা ভব্যতা উঠে যাওয়ার উপক্রম হয় তখনই দেখা দেয় সভ্যতার সংকট।
সভ্যতা ও ভব্যতার প্রশ্নটি আমাদের এই সময়ে কতটা প্রাসঙ্গিক? প্রাসঙ্গিক কিনা সামাজিক মাধ্যম, রাজনৈতিক বক্তৃতা, তর্জনগর্জন ও ছাত্র-তরুণদের কোনো কোনো মিছিলের স্লোগান, ভাইরাল হওয়া দুয়েকজন অ্যাকটিভিস্টের অশালীন বাকভঙ্গি, তাদের বিরুদ্ধে আবার সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণার ধরন দেখে ও শুনে ন্যূনতম বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন পাঠক নিজেই বলতে পারবেন- আমরা সভ্যতার কোন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি। বস্তুত সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক, এক্স হ্যান্ডেল, ইউটিউব অনেকটাই যেন হয়ে উঠেছে অসভ্যতার বাহক। এই মাধ্যমগুলো একই সঙ্গে আবার হয়ে উঠছে প্রচলিত গণমাধ্যমের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ।
বাংলাদেশে ফেসবুকের বয়স খুব বেশি হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যে এটা চিন্তা ও অপচিন্তা দুটোরই বিনিময়ের সহজ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ফেসবুক অবলম্বন করে গ্রাম, শহর ও নগর উপকণ্ঠে বিচরণরত একটি ভিন্ন ধারার সাংবাদিক শ্রেণিরও উদ্ভব ঘটেছে। মোবাইল ফোনে এরা ভিডিও ধারণ করে, অডিও রেকর্ড করে এবং সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত আপলোড করে ছড়িয়ে দেয়। সেসবের কোনো কোনোটির সংবাদমূল্যও রয়েছে। তবে নিউজ ভ্যালু থাকুক বা না থাকুক, সেসব অডিও ভিডিও অল্প সময়ের মধ্যেই ভাইরালও হয়ে যায়। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া সেসব ঘটনা দৈনিকগুলোও প্রায়শ সংবাদসূত্র হিসেবে গ্রহণ করে। আজকাল আবার পত্রিকায় বিবৃতি পাঠানোর পরিবর্তে রাজনৈতিক দলের নেতাদের কেউ কেউ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। সেই স্ট্যাটাস পিক করে রিপোর্ট তৈরি করে সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া। স্মরণযোগ্য ২০২৪ সালের জুলাই আগস্টের ছাত্র-গণ আন্দোলনকে শৃঙ্গে পৌঁছে দিতে ফেসবুকের অবদান নেহাত কম নয়। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার অনলাইন ভার্সন, নিউজ পোর্টাল ও টেলিভিশনে প্রকাশিত ও প্রচারিত রাজপথে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু বা আন্দোলনের প্রতিমুহূর্তের খবর কপি করে নেটিজেনরা বায়ুবেগে ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশ ও বিদেশের সবখানে। চব্বিশের ৩০ জুলাই নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে প্রহসনমূলক শোক পালনের সরকারি কর্মসূচির প্রতিবাদে সমন্বয়ক মাহিন সরকার মাথায় লাল কাপড় বেঁধে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করার কর্মসূচি দেন। সেই খবর প্রচারিত হলে মুহূর্তের মধ্যে বাংলাদেশের নেটিজেনদের প্রায় সবার ফেসবুক প্রোফাইল লাল হয়ে যায়। এটা নেটিজেনদের মধ্যে কারও না কারও উদ্ভাবন। সমন্বয়কারী মাথায় কাপড় বেঁধে ছবি তুলে আপলোড করতে বলেছিলেন। সেটা না করে ফেসবুক ইউজাররা প্রোফাইল লাল করেছিলেন নিজের বুদ্ধিতে। এর মধ্য দিয়ে লাল প্রতিবাদ সর্বজনীন হয়ে উঠেছিল। এই বিচারে ফেসবুক ব্যবহারকারীরাও মিলিতভাবে বড় এক সমন্বয়ক। এ ছাড়াও ফেসবুকে অনেক অজানা বিষয়েও জানা যায়। শিক্ষামূলক অনেক কিছুই ফেসবুক সামনে নিয়ে আসে। এগুলোর প্রশংসা তো করতেই হবে।
কিন্তু এই মাধ্যমটির অপব্যবহার করে অশ্লীলতা ও অসভ্যতার চারণভূমি বানিয়ে ফেলার যে ধারা শুরু হয়েছে, সেটাই সভ্যতার সংকট ঘনীভূত করে চলেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য এমন সব কনটেন্ট আপলোড করা হচ্ছে, যেগুলো একদিকে যেমন মানহানিকর, তেমনই অশালীন। চক্ষু ও কর্ণকে পীড়িত করে। জনগণের নেতা ও নেত্রী বলে যাদের মান্য করা হয়, তাদের অশ্লীল ব্যঙ্গচিত্র বানিয়ে (এগুলোকে কার্টুন বলা যায় না) অথবা মেকি ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।
এগুলো কোনো সভ্য মানুষের কাজ হতে পারে না। অথচ আমাদের সমাজে ফেসবুকের মাধ্যমে তা অহরহ করা হচ্ছে। ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক নেতাদের নাম বলে এমন সব অশালীন সেøাগান দিতে আমরা শুনেছি, যা এক বছর আগেও কল্পনা করা যায়নি। জুলাই আন্দোলনের দিনগুলোতে পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারা হলো, তবু কাউকে অশ্রাব্য সেøাগান দিতে শোনা যায়নি। আর এখন হজরত লুত (আ.)-এর কওমের যে অশ্লীল জীবনাচার তাদের ধ্বংস ডেকে এনেছিল সেই অনাচারের মৌলিক শব্দটিকে বানানো হয়েছে রাজনৈতিক সেøাগান। চিন্তা করা যায়! সেসব প্রচারিত হচ্ছে ফেসবুকে।
কয়েক দিন আগে সরকারের একজন উপদেষ্টা কক্সবাজার গিয়ে অসুস্থ হলেন। তাঁর স্ত্রী ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে স্বামীর আরোগ্যের জন্যে দোয়া চাইলেন। বাপ রে বাপ! কী ভয়াবহ অপরাধ যেন করে ফেললেন তিনি! কমেন্টে অনেকে বললেন আলহামদুলিল্লাহ। কেউ পড়েন ইন্না লিল্লাহ। কেউ অসুস্থ হলে, সে খবর জেনে সন্তোষ প্রকাশ করা ইসলাম সমর্থন করে না। এই মনোভাব মানবতাবিরোধীও বটে।। আলহামদুলিল্লাহ বলা, তা-ও ভালো; আরও শত শত কমেন্ট পড়েছে ‘পাকসার জমিনি ভাষায়।’ পাকসার জমিন হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস, অশ্লীল ভাষার জন্য যা নিন্দিত এবং পরিচিত। সেখান থেকে পাকসার জমিনি ভাষা। আরেকজন উপদেষ্টা বললেন ফেব্রুয়ারিতে ইলেকশন হবে। ফেব্রুয়ারিতে আমরা চলে যাব। বিবিসি অনলাইনে এই খবর প্রকাশ হলে শত শত অশ্রাব্য কমেন্ট। কমেন্ট তো নয়, অশালীন শব্দের ভাগাড়।
ফেসবুকে দেওয়া বিভিন্ন পোস্ট ও কমেন্টে অনেক সময় বাপ-মা তুলেও গালিগালাজ করা হয়। যাদের গালি দেওয়া হয়, পাকসার জমিনি ভাষায় যাদের ওপর রাগ-ক্ষোভ ঝাড়া হয়, তারা হয়তো রাগ করার মতোই কাজ করেছেন। তাই বলে এত বিশ্রী ভাষায় কটাক্ষ! পরিমার্জিত ভাষায় সমালোচনা করা যায় না? নিন্দাও করা যায়। রাজনীতির নিজস্ব ফ্রেইজোলজি বা বাকভঙ্গি রয়েছে। সেটা যেমন ধারালো তেমনই তির্যকও হতে পারে। কিন্তু অশ্লীল নয়। সামাজিক মাধ্যমে কনটেন্ট ও কমেন্টে যারা অশোভন ভাষা কিংবা মনোভাব প্রকাশ করেন, তাদের বেশির ভাগই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যতাড়িত অথবা রাজনীতির উপজাত চেতনার বাহক। এদের জীবনে ভব্যতার লেশমাত্র নেই। এদের স্থূলচিন্তার বহিঃপ্রকাশ দেখে মনে হয় মুমূর্ষু সভ্যতার গোঙানির শব্দ শুনছি। জানি রাজনীতির জায়গা থেকে বা মনোবিকৃতির কারণে যারা শিষ্টাচার বিসর্জন দিয়ে অশ্লীলতা ছড়িয়ে যাচ্ছে, তারা সমাজের অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ। কিন্তু বিপদ এই জায়গায় যে এদের অবস্থান বাতাসের ডগায়। বাতাস ভাগাড়ের উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে দেয় সবখানে। সেই বিষাক্ত গন্ধে সভ্যতা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে।
আমাদের সমকালীন সমাজের অশ্লীলতা ছড়িয়ে দিয়েছে আসলে গুটি কয়েক অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট। রাজনৈতিক ভাষ্য দেওয়ার নামে এরা অশ্লীলতার প্রসার ও চরিত্রহননের কাজ করে যাচ্ছে। এরা বিদেশে বসে গড্ডলিকা প্রবাহে ভেসে যাওয়া একটি প্রজন্ম তৈরি করতে চাইছে। এরা কখনো কখনো মবমাস্টারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক দিকনির্দেশনাও দিয়ে চলেছে। যে শিষ্টাচার বা ভব্যতা-সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখে, সেই জায়গায় হেনে চলেছে কেউটের ছোবল। জাতি যখন বড় বড় বিষয়ে তর্কে লিপ্ত তখন অলক্ষ্যে বিষ গেলানো হচ্ছে আমাদের। নির্বিবাদে ব্যবহৃত হচ্ছে জড়ভরত সমাজমাধ্যম। ফেসবুকের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড পরিণত হয়েছে বালির বাঁধে।
এ অবস্থাটিকে সভ্যতার সংকট বলা হলে খুব কি বেশি বলা হয়ে যায়! যে সমাজ গণতন্ত্রের আশায় প্রহর গণনারত সেই সমাজের অন্তর্মূলে অভব্যতার এ কোন স্রোত বয়ে চলেছে? গণতন্ত্র আর অভদ্রতা একসঙ্গে থাকতে পারে না। অসভ্যতা মানুষের সম্মান হরণ করে। গণতন্ত্র সম্মান সুরক্ষিত করে। মানবিক মর্যাদা লাভ প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। গণতন্ত্র সেই অধিকার নিশ্চিত করে। গণতন্ত্র মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেয়, আইনের শাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে ভয় তিরোহিত করে। পক্ষান্তরে অভদ্রতা বেয়াদবের অহংকার। বেয়াদব ভয় উৎপাদন করে। যদি আমরা সত্যিকারের গণতন্ত্র চাই তাহলে অবশ্যই সমাজের স্তরে স্তরে শিষ্টাচারের চর্চা করতে হবে। অসদাচরণকে সদাচার দিয়ে জয় করতে হবে। এটাই ধর্মের শিক্ষা। এটাই সভ্যতার দাবি।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক