বুধবার, ১৮ মে, ২০২২ ০০:০০ টা
অভিসার সিনেমা হল হয়ে যাচ্ছে অত্যাধুনিক সিনেপ্লেক্স

ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় চলচ্চিত্র

আলাউদ্দীন মাজিদ

ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় চলচ্চিত্র

ঈদের ছবি প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছে সিনেমা হলের উন্নয়নে চলতি সপ্তাহে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সিনেমা হল মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, ঈদের দিন রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে চালু হয়েছে ‘লায়ন সিনেমাস’ নামে একটি সিনেপ্লেক্স, রাজধানীর টিকাটুলির মোড়ের ঐতিহ্যবাহী ‘অভিসার’ সিনেমা হলটি এখন সিনেপ্লেক্সে রূপান্তর হচ্ছে, সম্প্রতি চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডকে পুনর্গঠন করা হয়েছে, সরকার ভারতীয় ছবি এ দেশে সীমিত আকারে মুক্তির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, সিনেমা হলের উন্নয়নে  ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে সরকার...। চলচ্চিত্রের উন্নয়নে এতসব উদ্যোগের পর এখন যে ‘ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছে চলচ্চিত্রের’ তা স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে বলে জানিয়েছেন চলচ্চিত্র বোদ্ধারা। চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ বলেন, এই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন চলচ্চিত্রকারদের ঐক্যবদ্ধতা এবং সম্মিলিত প্রয়াস।

১২ মে বন্ধ সিনেমা হল মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি কীভাবে বন্ধ সিনেমা হল খোলা যায় তা নিয়ে সবার সঙ্গে মত বিনিময় করেছেন। সভায় সারা দেশ থেকে ১১৭টি সিনেমা হলের মালিক অংশ নেন। বৈঠকে তথ্য সচিব মকবুল হোসেন, চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস, অভিসার সিনেমা হল মালিক সফর আলী ভূঁইয়াসহ অনেকে বক্তব্য রাখেন। এতে সরকারের কাছে সিনেমা হল মালিকদের মূল দাবি ছিল পর্যাপ্ত ও মানসম্মত দেশীয় ছবির অভাবে সিনেমা হল চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে সিনেমা হলের আধুনিকায়ন করে আরও লোকসানের কবলে পড়তে চান না তাঁরা। এই অবস্থার উত্তরণে প্রয়োজন বছরে কমপক্ষে ১০-১২টি ভারতীয় নতুন ছবি আমদানির অনুমতি দেওয়া। এ ছাড়া সিনেমা হলের উন্নয়নে সরকার প্রদত্ত ঋণ পেতে ব্যাংকের নিয়মনীতি ও বিধিমালা সহজ করতে হবে। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সভায় উপস্থিত ব্যাংক কর্মকর্তারা ইতিবাচক সাড়া দেন। তথ্যমন্ত্রী বলেন, ভারতীয় ছবি আমদানিতে সিনেমা হল মালিকদের দাবির প্রতি সরকারের সম্মতি রয়েছে। এখন প্রয়োজন চলচ্চিত্রের সব সংগঠন বিশেষ করে শিল্পীদের এ ক্ষেত্রে মত গ্রহণ করা। সবাই যদি একমত হয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেন তাহলে ভারতীয় ছবি আমদানিতে আর কোনো বাধা থাকবে না। প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস বলেন, ভারতীয় ছবি আমদানিতে সরকার তার ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছে। আমরা কিন্তু অনেক আগে থেকেই এই দাবি জানিয়ে দেনদরবার করে আসছিলাম। আশা করি চলচ্চিত্রের উন্নয়নে বৃহত্তর স্বার্থে চলচ্চিত্রের ১৯টি সংগঠন এ বিষয়ে একমত হবে। এতে চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা বাস্তবায়ন হবে। এদিকে এবারের ঈদের ছবি সাফল্য পেয়েছে। চলচ্চিত্রকাররা ভাবছেন ঈদের ছবির সাফল্যের এই ধারাবাহিকতা কীভাবে ধরে রাখা যায়।

ঈদের ছবির এমন সাফল্যে নির্মাতারা এবার নড়েচড়ে বসেছেন। আগামী কোরবানির ঈদে ছবি মুক্তি দেওয়ার জন্য অনেকে এখন থেকে হিসাবনিকাশ করা শুরু করে দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত জানা গেছে, ঈদুল আজহায় মুক্তি পেতে পারে তিন নায়কের বিগ বাজেটের তিনটি ছবি। এগুলো হলো- শাকিব খানের ‘অন্তরাত্মা’, অনন্ত জলিলের ‘দিন : দ্য ডে’ এবং সিয়ামের ‘অপারেশন সুন্দরবন’। তিনটি ছবি নিয়ে এখন থেকেই সিনেমা হল মালিকরাও আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য এই ঈদে দর্শকদের হলমুখী হওয়ার বিষয়টি ‘সিনেমা ঘুরে দাঁড়ানোর সবুজ সংকেত’ হিসেবে দেখছেন চলচ্চিত্রের মানুষ। তাঁরা বলছেন, হলমুখী এই দর্শকদের এখন নিয়মিত হলে আনতে পরিচালক ও প্রযোজকদের ভাবতে হবে। এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে সিনেমার সুদিন ফিরবে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা কাজী হায়াৎ বলেন, ‘এই ঈদে ছবি দেখার জন্য দর্শক হলে ফিরেছে- এটা চলচ্চিত্রকারদের জন্য দারুণ খবর। এই ধারাবাহিকতা কীভাবে রক্ষা করা যায়, এর জন্য সবাইকে মিলে এগোতে হবে। দেশের সিনেমা বাঁচাতে আমাদের শেষ লড়াইটা এবার করা প্রযোজন। তাই এখন দর্শকদের জন্য সেরা গল্পের সেরা ছবি নির্মাণ করতে হবে।’ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল বলেন, সিনেমা হলে সব শ্রেণির মানুষ সপরিবারে আবার ফিরেছে। তারা তাদের পছন্দের ছবি পেয়েছে। এখন পরিচালক ও প্রযোজকদের উচিত ভালো ছবি নির্মাণ অব্যাহত রাখা। আরেকবার প্রমাণ হলো, চলচ্চিত্রের সুদিন ফেরানোর একমাত্র পথ হলো পর্যাপ্ত ও মানসম্মত দর্শক পছন্দের ছবি। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মতিন রহমান বলেন, দর্শক এবার ঈদের সুনির্মিত ছবিগুলো দেখে আনন্দিত। এটা সুখবর। গল্প বাছাই ও গল্প বলার ধরন ভালো ছিল বলেই প্রেক্ষাগৃহে এসে ঈদে সিনেমা দেখছেন দর্শক। এই সুনির্মাণের ধারা বজায় রাখতে হবে। নব্বই দশকের শেষদিক থেকে অশ্লীলতা, পাইরেসি, মানসম্মত ছবির অভাব ও নকল ছবির কারণে দর্শক সিনেমা হলবিমুখ হয়ে পড়ে। এতে ব্যবসায়িক লোকসান গুনতে গুনতে সিনেমা হল মালিকদের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখন থেকেই সিনেমা হল বন্ধ করা শুরু হয়। নব্বই দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত দেশের ১ হাজার ৪০০ সিনেমা হল বন্ধের কবলে পড়ে। এখন আছে মাত্র অর্ধশতাধিকের মতো। সিনেমা হল মালিকদের একটিই দাবি ছিল মানসম্মত ও পর্যাপ্ত ছবি চাই। না হলে সিনেমা হল বন্ধ রোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এর জন্য হল মালিকরা বিদেশি ছবিও নিয়মিত আমদানির দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন করেছে সরকার। এতে তথ্য সচিবকে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। যুক্ত হয়েছেন নতুন সদস্যও। ১৭ এপ্রিল তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র-১ শাখা থেকে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে বলা হয়, চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিব ছাড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে ১৩ জন সদস্য রাখা হয়েছে। কর্মকর্তা ছাড়াও এতে আছেন চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনয়শিল্পী ও সাংবাদিক। সেন্সর বোর্ডে যুক্ত হয়েছেন চলচ্চিত্রের মানুষ।

এদের একজন চিত্রনায়িকা রোজিনা বলেন, আমি চাইব আমাদের চলচ্চিত্র বিশ্ব মানের হোক। বর্তমানের চলচ্চিত্রের ধস এক দিনে হয়নি। সবাই মিলে চাইলে এই চলচ্চিত্রকে আবার মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। সবার মিলিত চেষ্টায় এই চলচ্চিত্র ঘুরে দাঁড়াতে পারে। দ্বিতীয়ত. এবার সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবে আমার দায়িত্ব অন্যরকম। ছবিটা দেখার পর ভাবব-গল্পটা কোনদিকে মোড় নিচ্ছে। এতে দেশের কথা, জীবনের কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা আছে কি না। চলচ্চিত্রে অবশ্যই একটা বাণিজ্যিক দিক থাকতে হবে। তারপরও দেখতে হবে এগুলো আমাদের রাষ্ট্রের জন্য শোভনীয় কি না।

 

অভিসার সিনেমা হচ্ছে সিনেপ্লেক্স

রাজধানীর অভিসার সিনেমা হলটি রূপান্তরিত হচ্ছে সিনেপ্লেক্সে। চলচ্চিত্রের উন্নয়ন নিয়ে যখন চেষ্টা চলছে তখনই এমন সুখবরটি জানালেন এই সিনেমা হলের চেয়ারম্যান সফর আলী ভূঁইয়া। তিনি বলেন, এখন সিঙ্গেল স্ক্রিন মানে সিনেমা হলের সময় নয়, সময় হচ্ছে সিনেমা দেখার আধুনিক ব্যবস্থা সিনেপ্লেক্সের। তাই এই সিনেমা হলটিকে ২০০ আসনের মনোরম সিনেপ্লেক্সে রূপান্তরের কাজ শুরু করে দিয়েছি। দর্শকদের স্বাচ্ছন্দ্যে ছবি দেখার জন্য অত্যাধুনিকভাবে আগামী ২ মাসের মধ্যে গড়ে তোলা হবে ‘অভিসার সিনেপ্লেক্স’।

সর্বশেষ খবর