রবিবার, ১২ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

সুদিনের অপেক্ষায় চলচ্চিত্র

আলাউদ্দীন মাজিদ

সুদিনের অপেক্ষায় চলচ্চিত্র

►    চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুদানের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে

►   এফডিসি কমপ্লেক্স নির্মাণ দ্রুত শেষ হবে

►   শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুদান দেওয়া হবে

►   ফিল্মসিটি অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং সুযোগ-সুবিধা পাবে

►  সেন্সর বোর্ড বাদ দিয়ে সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে

 

রাত যত গভীর হতে থাকে সকাল তত কাছে আসতে থাকে। তাহলে কী এখন চলচ্চিত্রের উঠোনে রোদ হাসবে? এমন প্রশ্ন চলচ্চিত্রের মানুষের। চলচ্চিত্রকে ঘিরে তাদের এমন সুদিনের স্বপ্ন দেখালেন চলচ্চিত্রবান্ধব আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০২১ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দিতে গিয়ে চলচ্চিত্রের সুদিন ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর নানা সময়োপযোগী পরিকল্পনার কথায় এখন উচ্ছ্বসিত চলচ্চিত্রকাররা।

চলচ্চিত্রকারদের কথায় প্রধানমন্ত্রী চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ দিয়েছেন। তিনি নিজেও আগামী বাজেটে উদ্যোগ নেবেন এই অনুদানটা বাড়িয়ে দেওয়ার। কেননা বরাদ্দ ভালো থাকলে ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, আমাদের সবার মাঝে মেধা আছে, চিন্তাশক্তি আছে এবং শৈল্পিক  মনোভাবটা আছে। করোনার সময় অর্থনৈতিক মন্দা ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি দারুণভাবে বেড়েছে। সেখানে সরকার যে অনুদান দিচ্ছে, এটা একটা পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য যথেষ্ট নয়। এই অনুদান আরও বাড়াতে হবে বলে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করায় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে গেছে। চলচ্চিত্র গবেষক আনুপম হায়াৎ বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেন, সম্প্রতি আমাদের কিছু চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এবং দেশের মানুষও সেগুলো লুফে নিয়েছে এবং দেশের সীমানা পেরিয়ে বাইরেও সেগুলো চাহিদা পেয়েছে। কাজেই সেভাবেই আমাদের কাজ করা দরকার। এফডিসিতে কমপ্লেক্স তৈরির কাজের ধীরগতিতে উষ্মা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী কাজ দ্রুত শেষ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। গাজীপুরে নির্মাণাধীন ফিল্মসিটি অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন করে গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, তাঁর সরকার ফিল্ম আর্কাইভ এবং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট করে দিয়েছে। এখন প্রশিক্ষণটা জরুরি। তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশে সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একসময় চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড নিয়ে অনেক অভিযোগ ছিল। তাই এখন এই সেন্সর বোর্ড বাদ দিয়ে সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যা আরও উৎকর্ষতা সাধনের জন্যই করা হয়েছে। তবে, নির্মাণাধীন চলচ্চিত্রে সমাজের জন্য ক্ষতিকর কিছু থাকলে সেগুলো অবশ্যই পরিহার করা হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, সরকার যাতে ভবিষ্যতে সার্টিফিকেশন পদক্ষেপটা আইনগতভাবে নিতে পারে সে জন্য ব্যবস্থাটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের ওপরও গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, আমরা এই বিষয়টায় একটু পিছিয়ে আছি। এক্ষেত্রে আরও অনেক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা উচিত। এ ধরনের চলচ্চিত্র যারা নির্মাণ করবেন তাদের জন্য আনুদানটা আর একটু ভালোভাবে দেওয়া দরকার বলে আমি মনে করি। মোরশেদুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর এই পরিকল্পনাকে সাধুবাদ জানান।

চলচ্চিত্রকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি কাজী হায়াৎ বলেন, অশ্লীলতা ও পাইরেসি বন্ধে সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অশ্লীল চলচ্চিত্র নির্মাণ ও পাইরেসি বন্ধে একটা টাস্কফোর্স গঠন করা হচ্ছে। সেটি হলে এগুলো বন্ধ হবে। পুরনো চলচ্চিত্র বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলো যেন হারিয়ে না যায় সে জন্য এগুলো ডিজিটালাইজড করে নতুনভবে প্রদর্শনের উদ্যোগ নেওয়ার ওপরও তিনি জোর দিয়েছেন। কেননা এই চলচ্চিত্রগুলোর আবেদন কোনো দিনও শেষ হওয়ার নয়। বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে ভালো মানের প্রশিক্ষণ দরকার। তাহলে শিল্পী-কলাকুশলীদের উৎকর্ষতা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। তাই প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। কাজী হায়াৎ বলেন, প্রতি বছর সৃজনশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুদান দেয় সরকার। স্বল্পদৈর্ঘ্যে ২৫ লাখ এবং পূর্ণদৈর্ঘ্যে ৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অনুদান দেওয়া হয়। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে অনুদানের অর্থের পরিমাণ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘করোনার পর এখন সবকিছুতে খরচ বেড়ে গেছে। এ মুহূর্তে ৭৫ লাখ টাকা একটি ছবি নির্মাণের জন্য কিছুই নয়। স্বল্পদৈর্ঘ্যে ২৫ লাখও কিছুই নয়। এ অর্থ বাড়ানো উচিত। আগামী বাজেটে যাতে এ অর্থ বাড়ানো যায় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব।’ শিশুতোষ চলচ্চিত্রের জন্য আলাদা অনুদানের ব্যবস্থাও করতে বলেন তিনি। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে দ্রুত বিএফডিসি ভবন নির্মাণকাজ শেষ করার তাগিদ দেন। সেই সঙ্গে চলচ্চিত্র শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্টে শিল্পীদের তাঁদের আয় থেকে একটা অংশ জমা দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যে শিল্পী এই ফান্ডে টাকা দেবেন তাঁর নাম যেন ওয়েবসাইটেও দেওয়া হয়। এতে করে কারা এ ফান্ডে অর্থ দিয়েছেন তা সবাই জানতে পারবেন। চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জীবনধর্মী ভালো সিনেমা  তৈরি করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এমন সিনেমা দরকার বাবা-মা, ভাই-বোন, সবাই মিলে যাতে দেখতে পারে। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি কাজী শোয়েব রশীদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, আধুনিক সিনেমা হল নির্মাণে ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে সরকার। সেখান থেকে স্বল্প সুদে ঋণ পাবেন হল নির্মাতারা। শোয়েব রশীদের মতে সিনেমা হলের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর এমন উদ্যোগে আমরা সিনেমা হল নিয়ে আশার আলো দেখছি।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মতিন রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান আরও জাঁকজমক হওয়া দরকার, তাই আগামীতে আমি চাই আরও নান্দনিকভাবে এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানটা যাতে হয়। মতিন রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য তাঁর প্রকৃত সংস্কৃতিবান্ধব মনেরই পরিচয় বহন করে। মতিন রহমান আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, যাঁরা আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিক,  যাঁরা সাহিত্য রচনা করেন এবং যাঁদের রচনার ওপর ভিত্তি করেই সিনেমা হয় তাঁরাও যদি এরকম জীবনধর্মী রচনা তৈরি করেন, নাটক তৈরি করেন বা সাহিত্য তৈরি করেন আর তার ওপর ভিত্তি করে যদি সিনেমাগুলো হয় সেটা আমাদের সমাজটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।

চলচ্চিত্রকাররা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, এমন সাংস্কৃতিকবান্ধব প্রধানমন্ত্রী ইতোপূর্বে আমরা পাইনি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার চলচ্চিত্রকে উজ্জীবিত করার যে প্রত্যয় নিয়ে এগোচ্ছেন তাতে চলচ্চিত্রের হারানো গৌরব ও সুদিনে ফেরা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

সর্বশেষ খবর