১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামে যাত্রা শুরু করা ব্যান্ড সোলসের ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে চলতি বছর। এ উপলক্ষে নানা উদ্যোগ নিয়েছে দলটি। কেমন ছিল গান নিয়ে তাদের এই পথ-পরিক্রমা। আর এখন কেমন আছে সেই সোলস, সে কথাই তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
৫০ বছরে চট্টগ্রামের ‘সোলস’
‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ কিংবা ‘কলেজের কড়িডোরে’- সোলস ব্যান্ড দলের এমন অনেক জনপ্রিয় গান এখনো শ্রোতাদের নস্টালজিয়ায় ভোগায়। এই ব্যান্ডটির জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। এরমধ্যে ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। শৈশব-কৈশোর চট্টগ্রামে কাটিয়ে তিন দশক ধরে থিতু হয়েছে ঢাকায়। এখন এই দলটির বিচরণ বিশ্বজুড়ে। তপন চৌধুরী, নকীব খান, আইয়ুব বাচ্চুকে পেরিয়ে দলটির হাল এখন পার্থ বড়ুয়ার হাতে। সবার জন্মই সমুদ্রকন্যা চট্টগ্রামে। আদি ও অন্যতম ব্যান্ড ‘সোলস’। ব্যান্ডটির বর্তমান পাঁচ সদস্যের তিনজনই এখনো চট্টগ্রামেরই; নাসিম আলী খান, পার্থ বড়ুয়া ও রিয়েল। বাকি দুজনের মধ্যে মাসুম মুন্সীগঞ্জের আর আশিক হলেন খুলনার। সোলসের পথচলা শুরু ১৯৭৩ সাল থেকে, চট্টগ্রামে। তবে সূত্রপাত হয়েছে তারও এক বছর আগে (১৯৭২)। সাজেদ উল আলমের নেতৃত্বে কয়েক তরুণ ‘সুরেলা’ নামের একটি ব্যান্ড গঠন করে। ১৯৭৩ সালে ব্যান্ডের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘সোলস’। সাজেদ, লুলু ও রনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ধারাবাহিকভাবে সোলসে যোগ দেন নকীব খান, পিলু খান, তপন চৌধুরী, নাসিম আলী খান, আইয়ুব বাচ্চু, রনি বড়ুয়া, নেওয়াজ, পার্থ বড়ুয়াসহ অনেকে। এরমধ্যে নাসিম আলী খান ও পার্থ বড়ুয়া এখনো ‘সোলস’-এর পতাকা আগলে আছেন। সঙ্গে আছেন আহসানুর রহমান আশিক (ড্রামস), মীর শাহরিয়ার মাসুম (কি-বোর্ড) ও মারুফ হাসান রিয়েল (বেজ গিটার)। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয় সোলসের প্রথম অ্যালবাম ‘সুপার সোলস’। এটি ছিল দেশের ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় অ্যালবাম।
বর্ষপূর্তিতে সিলেটের গান
সোলসের ৫০ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম চট্টগ্রামের বাইরে কোনো আঞ্চলিক গান নিয়ে হাজির হলো দলটি। প্রকাশ হলো ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সোলসের বিশেষ গান ‘কিতা বাইসাব বালানি’। এটি সিলেট অঞ্চলের লোকপ্রিয় একটি গান। গানটির প্রধান কণ্ঠ যথারীতি পার্থ বড়ুয়া।
প্রথম পুরস্কার প্রাপ্তি
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে পপ মিউজিকের একটি প্রতিযোগিতায় নাম লেখায় ‘সোলস’, জিতে নেয় সেরার পুরস্কার। মূলত সেই থেকেই শুরু হয়েছিল সোলসের জয়যাত্রা।
প্রথম পূর্ণাঙ্গ অ্যালবাম
১৯৮০ সালে বের হয় সোলসের প্রথম অ্যালবাম ‘সুপার সোলস’। এটিই ছিল বাংলাদেশের কোনো ব্যান্ডের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ও প্রথম রক অ্যালবাম। সেই অ্যালবামের ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’, ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’, ‘এই মুখরিত জীবন’ গানগুলো অলটাইম হিটস। সোলসের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘কলেজের করিডোরে’ বের হয় ১৯৮২ সালে। সোলসের ১৩তম এবং সর্বশেষ অ্যালবাম ‘বন্ধু’ বের হয় ২০১৭ সালে।
সোলস ছড়েন যাঁরা...
১৯৮২ সালে ‘কলেজের করিডোরে’ অ্যালবাম করার পরই নকীব খান ও পিলু খান ‘সোলস’ ব্যান্ড ছেড়ে পরবর্তীতে ‘রেনেসাঁ’ গঠন করেন। ১৯৮৯ সালে আইয়ুব বাচ্চু সোলস ত্যাগ করে নতুন ব্যান্ড ‘এলআরবি’ গঠন করেন। ১৯৯২ সালে ব্যান্ডের ২০ বছর পূর্তিতে ‘এ এমন পরিচয়’। ছিল তপন চৌধুরীর সঙ্গে সোলসের শেষ অ্যালবাম। এরপর তপন চৌধুরী সোলস ছেড়ে পুরোপুরি সলো ক্যারিয়ারের দিকে ঝুঁকে পড়েন।
প্রয়াত হয়েছেন যাঁরা...
সোলস পরিবারের দুই সদস্য না ফেরার দেশে চলে গেছেন ইতোমধ্যেই। তাঁরা হলেন ব্যাজ গিটারিস্ট শাহেদুল আলম এবং লিড গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট আইয়ুব বাচ্চু।
সোলসের হাল যাঁদের হাতে এখন-
৫০ বছর অতিক্রম করা দলটির ৩২ বছর হাল ধরে আছেন পার্থ বড়ুয়া। সঙ্গে আছেন আরেক জ্যেষ্ঠ সদস্য নাসিম আলী খান। বর্তমান লাইনআপে আরও আছেন আহসানুর রহমান আশিক (ড্রামস), মীর শাহরিয়ার মাসুম (কি-বোর্ড) ও মারুফ হাসান রিয়েল (বেজ গিটার)।
সেপ্টেম্বর থেকে নতুন গান : পার্থ
৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ৫০টি নতুন গান প্রকাশ করবে সোলস। দেশ ও দেশের বাইরে কনসার্টেও গাইবে। আগামী ৯ ও ১০ জুলাই ইংল্যান্ডে কনসার্ট করবে। এসব তথ্য জানিয়ে বর্তমান দলপ্রধান পার্থ বড়ুয়া বলেন, সেপ্টেম্বর থেকে গান প্রকাশ শুরু হবে। ২০২৪ সালের শেষে একটি গ্র্যান্ড কনসার্ট আয়োজনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে সোলসের ৫০ বছর পূর্তির এ আয়োজন।
সোলসে মৌলিক গানের ধারা শুরু হয়
নকীব খান
সোলসে যুক্ত হওয়ার গল্পটা কেমন-
স্বাধীনতার পর আমরা তিন ভাই বালার্ক নামে একটি ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। পরে সেখান থেকে ১৯৭৪ সালে সোলসে যোগ দিলাম। প্রথম থেকেই কি-বোর্ড, অর্গান এবং ভোকালিস্ট হিসেবেই কাজ শুরু করি। তাছাড়া সোলসে যোগদানের পর আমার পরামর্শে সোলসে মৌলিক গানের ধারা শুরু হয়।
সোলসে যুক্ত হওয়ার কারণটা কী ছিল?
আসলে সোলস ছিল জাতীয় পর্যায়ে প্রথম জনপ্রিয় একটি ব্যান্ড দল। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতে সোলসের অবদান অপরিসীম। একটি ব্যান্ড দলকে আধুনিক বাংলা গানের ফর্মে নিয়ে আসার কৃতিত্ব দেখিয়েছিল সোলস। যে কারণে দলটি শুরুতেই দেশ-বিদেশে সহজেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এসব কারণেই আসলে সোলসের প্রতি আমি আকৃষ্ট হই।
পরে সোলস ছেড়ে গেলেন কেন?
১৯৮৩ সালে বাবার মৃত্যুর পর ঢাকায় থাকা আমার বড় ভাইয়ের কাছে আমি ও আমার ভাই সোলসের ড্রামার শাহবাজ খান পিলু চলে আসি। ঢাকায় আসার পর ১৯৮৫ সালে আমি এখানে রেনেসা নামে একটি ব্যন্ড দল গঠন করি। আমার ঢাকায় চলে আসার পেছনে আরও একটি কারণ ছিল, আসলে জাতীয় পর্যায়ে কিছু করতে গেলে ঢাকা ছাড়া কোনো কিছু করার কোনো উপায় নেই। এ কারণে সোলসও পরে ঢাকায় চলে আসে।
সোলসের ৫০ বছর পূর্তিতে অনুভূতি কেমন?
সোলস তার মৌলিকত্ব ধরে রেখে এখনো এগিয়ে চলেছে। এটি এই ব্যান্ড দলটির বড় কৃতিত্ব। শুরুতে যে মেলোডি বেজ গান নিয়ে সোলস যাত্রা শুরু করে তা এই ৫০ বছরে এসেও ধরে রাখার জন্য পার্থ বড়ুয়াসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সাধুবাদ জানাই।
মনে হয় স্বপ্ন দেখছি
নাসিম আলী খান
প্রায় শুরু থেকেই সোলসের সঙ্গে যুক্ত আছেন, ৫০ বছর পূর্তির অনুভূতি কেমন?
আমাদের জন্ম চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম আমাদের হৃদয়ে। তবে ব্যান্ডটি এখন আর চট্টগ্রামে আটকে নেই, গোটা দেশ পেরিয়ে সোলস এখন বৈশ্বিক একটি প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়েছে। ব্যান্ডটির ভক্ত-শ্রোতা সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে আছে। ৫০ বছরের উৎসব পালন উপলক্ষে আমরা বিদেশে প্রথম কনসার্ট করছি লন্ডন থেকে। আসলে কখনো ভাবতে পারিনি ৫০ বছর পূর্তি করতে পারব। কখন যে রোদ-মেঘে বেলায় বেলায় এতটা সময় পার হয়ে গেল তা ভাবতেই স্বপ্নের মতো লাগে। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সোলসের যে যাত্রা তা খুবই সমৃদ্ধ। এতে এই ব্যান্ডের একজন সদস্য হিসেবে আমি গর্ববোধ করি।
অন্য যাঁরা এই ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং আছেন তাঁদের নিয়ে কী বলবেন?
আমি তো ১৯৭৭ সালে যুক্ত হই। প্রথম থেকে যাঁরা এই ব্যান্ডে ছিলেন, এখনো আছেন বা যাঁরা নেই সবার প্রতি আমার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা রইল। কারণ সবার সময়োপযোগী চিন্তাভাবনা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল জাতীয় পর্যায়ে প্রথম জনপ্রিয় এই ব্যান্ড দল সোলস।
সোলস নিয়ে আগামী ভাবনা কী?
৫০ বছরের পথচলার ইতিহাসে সোলসের যে অবদান তা চিরদিনের হয়ে থাকবে। কারণ এই দলের সবাই মেধাবী এবং দূরদর্শী ভাবনার অধিকারী। আবারও বলছি কীভাবে এতটা সময় পার হয়ে গেল বুঝতেই পারছি না। মনে হয় স্বপ্ন দেখছি।
প্রত্যাশার কথা শুনতে চাই।
কোনো একটি ব্যান্ড দলে একজন সিংগারের খুব বেশি গান থাকে না। সেই তুলনায় সোলস সিংগারদের অনেক গান, তাও আবার সবই জনপ্রিয়। এটি সোলসের একটি রেকর্ড। আগামীতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে, এই আমার প্রত্যাশা।