সংগীত জগতের জীবন্ত কিংবদন্তি সৈয়দ আবদুল হাদী। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিসেনাদের দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করেছিল তাঁর গাওয়া কালজয়ী অনেক গান। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে- পান্থ আফজাল
কেমন আছেন? জীবনের এ পর্যায়ে এসে কখনো কি প্রাপ্তিযোগ নিয়ে ভেবেছেন?
অনেক ভালো আছি। স্বাধীনতা অর্জন আমাদের বড় প্রাপ্তি। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি কিছু আছে? তবে ওই যে বললাম, স্বাধীনতার এত দিন পরও আমরা বিভাজন কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কোনো ক্ষেত্রেই বিভাজন ঠিক নয়। আমার তো মনে হয় না, অন্য কোনো দেশে এরকম বিভাজন আছে!
খ্যাতিমান শিল্পীদের শ্রোতাপ্রিয় গানগুলো নতুন করে এ প্রজন্মের শিল্পীরা গাইছেন। এটা কীভাবে দেখছেন?
নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা গাইছে, এটা কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু গানের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা থাকতে হবে। আর সেই গানগুলো নতুন করে গাইতে হলে অবশ্যই শিল্পীর কাছে অনুমতি নিতে হবে। গানটাকে ভালোভাবে শুদ্ধ করে গাইতে হবে। কারণ ওই গানটা সেই শিল্পীই পরিচিত করিয়েছেন।
সংগীত জীবন নিয়ে কতটা তৃপ্ত মনে হয়?
আসলে তৃপ্ত বলাটা খুবই মুশকিল। আমার মনে হয়, কোনো শিল্পীই তৃপ্ত হয় না। কারণ, তৃপ্ত হয়ে গেলে তো সবই শেষ হয়ে গেল। বরং উল্টো করেই বলি, আমার তেমন অতৃপ্তি নেই। আমার কাছে সবচেয়ে বড় হলো মানুষের ভালোবাসা।
নতুন প্রজন্মের জন্য আপনাদের মতো লিজেন্ডদের আরও কিছু করার ছিল?
সেটা ঠিক। আমরা নতুন প্রজন্মের জন্য অনেক কিছুই করতে পারিনি। এটা আমাদের দায়। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা অর্জন এবং এর সাফল্য নতুন প্রজন্মের কাছে আমরা সঠিকভাবে পৌঁছাতে পারিনি। আরও বেশি কিছু করা উচিত ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোর কথা বিস্তারিত বলবেন?
মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলো সারা দেশের মানুষের জন্য ছিল অনিশ্চয়তার, শঙ্কার। সেই সময়গুলো এখনো দুঃসহ স্মৃতি। আমি তখন বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। এর মধ্যে আবার আলতাফ ভাই ধরা পড়ে গেলেন। বলার অনেক কিছুই আছে। এসব নিয়ে তো অনেক বই লিখলেও শেষ হবে না। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে মেশিন গান ফিট করা থাকত। সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে সার্চ করা হতো। সে ভয়াল সময়ের কথা এখনো মনে পড়ে।
এমন কোনো ঘটনা আছে যা এখনো শিহরিত করে?
আমার এক বন্ধু ছিল। তার ওপর সেই সময় হুলিয়া জারি হলো। আমি আমার বন্ধুকে সেই সময় আমার বাড়িতে লুকিয়ে রাখলাম। আমার বাসা সার্চ হলো। তবে ভাগ্য ভালো ছিল, সে তখন ধরা পড়েনি। ওই সময় রাস্তায় বের হলেই সার্চ করা হতো। ভয়াবহ সেই অবস্থা। এখনো মনে পড়লে গা থমথম করে ওঠে।
স্বাধীনতাযুদ্ধে আপনার সম্পৃক্ততা?
সারা দেশের শিল্পীদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গান করতাম। বিভিন্ন বিপ্লবী ও প্রেরণামূলক গান গেয়ে আমরা দেশের মানুষদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করতাম।
নিজের লেখা-সুর করা গান করেছিলেন...
হুম। আমি অন্যান্য গানের সঙ্গে নিজের লেখা ও সুর করা গানও করেছি। অনেক গান সেই সময় রেকর্ড ছিল না। সেই রকম ব্যবস্থাও ছিল না। এখন সেই সব গান পাওয়াও যাবে না। এসব গান সেই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জোগাত। মুহূর্তের মধ্যেই আমরা সুর করতাম, লিখতাম। সঙ্গে আলতাফ ভাই, খান আতা ভাই ছিলেন। বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের সবাই ছিলেন। মনে ও ধ্যানে এক মন্ত্র ছিল-‘দেশ’।
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস আমরা ঠিকমতো তুলে ধরতে পেরেছি কি?
সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে গেলে একেবারে নির্মোহভাবে করতে হয়। আমরা তা পারিনি। দুঃখ লাগে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে একেকজন একেক কথা বলে। রাজনৈতিকভাবেই এটা করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে সন্দেহ, বিভাজন, বিতর্ক থাকা ঠিক নয়।