যুগ যুগ ধরে যাত্রাপালা, মঞ্চনাটক, সিনেমা, টেলিভিশন নাটক আমাদের মানসিক প্রশান্তির এক শক্তিশালী মাধ্যম। কিন্তু বর্তমান অবস্থা কেমন, এখন সস্তা, স্থূল, মেধাহীন, ভাঁড়ামি, সুড়সুড়িমূলক কিছু নির্মাণ আমাদের সংস্কৃতিকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দিচ্ছে, যা অপসংস্কৃতির চূড়ান্ত নিদর্শন। এসব নিয়ে আমাদের সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বরা কী ভাবছেন? লিখেছেন- পান্থ আফজাল
ববিতা
সুস্থধারার সংস্কৃতি আর অসুস্থধারার সংস্কৃতি কী আমাদের তা বুঝতে হবে। অসুস্থধারার সংস্কৃতিতে প্রবেশ আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। আমার ঘরের কাজের লোকটিও আমাদের দেশের নাটক-সিনেমা দেখে না। তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলে, এসব নাটক-সিনেমা দেখতে তাদের ভালো লাগে না। তারা বলে হিন্দি সিরিয়াল দেখতে ভালো লাগে। এই যে বিদেশি কনটেন্ট আমাদের দেশে অবাধে প্রবেশ করছে, কারও যেন কিছুই বলার নেই। এসব বিষয়ে আমাদের বলে যেন কখনই কিছুই হয় না। যারা এসব বিষয়ে জানেন, নীতিনির্ধারক বা আইন প্রণয়ন করেন, তারা যেন সচেতনভাবে এ বিষয়টিতে গুরুত্ব দেবেন আশা রাখছি।
আবুল হায়াত
সংস্কৃতি এখন আর মানুষের হাতে নেই। এটা চলে গেছে বেনিয়াদের হাতে। এরা ব্যবসায়ী চিন্তাভাবনা আর স্বার্থসিদ্ধি উদ্ধারে সর্বত্র সংস্কৃতির ওপর লাঠি ঘোরাচ্ছে। তারা যা দেখাতে চায় তাই তো দেখছে সবাই। মাঝে তো অশ্লীলতা ঢুকে গিয়ে মিডিয়া নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এখন কিছুটা হলেও কমেছে। আসলে সুস্থধারার সংস্কৃতি বিনির্মাণে এখন আর কারও কোনো চেষ্টা নেই। কারও সময়ও নেই এসব নিয়ে ভাবার। চলচ্চিত্র ও টিভি মিডিয়া তো বেনিয়াদের হাতে পুরোপুরি চলে গেছে। তবে আশার কথা, থিয়েটার অঙ্গন কিছুটা হলেও সুস্থ আছে। এখানে এখনো শুদ্ধ সংস্কৃতির চর্চা হয়, ভালো ভালো স্ক্রিপ্টে কাজ হয়।
দিলারা জামান
সুস্থ সংস্কৃতি তো কমে গেছে, সংস্কৃতির মধ্যে অপসংস্কৃতি ঢুকে গেছে। ফলে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যদি নাটক ইন্ডাস্ট্রির কথা বলি তাহলে বলব, তাড়াহুড়ো করে একগাদা নাটক নির্মিত হচ্ছে এ সময়ে। অভিনয় না শিখে আসা কিছু শিল্পীকে নাটকে যুক্ত করা হচ্ছে। অশ্লীল ভাষা ও অঙ্গভঙ্গির নাটক নির্মাণ করা হচ্ছে। ভাষাকে বিকৃত করে আজগুবি ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে। ভালো কনটেন্ট খুবই কম; একই রকম গল্প। দায়সারা কাজ। ফলে ভালো নাটক দেখা থেকে দর্শক বঞ্চিত হচ্ছে। ভিউ দিয়ে জনপ্রিয়তা কাউন্ট করা হচ্ছে। দিনকে দিন সিনিয়র চরিত্রের কাটছাঁট করা হচ্ছে। আর সব কিছু নির্দিষ্ট কিছু বিনিয়োগকারী নিয়ন্ত্রণ করছেন।
ডলি জহুর
শিক্ষিত, যোগ্য, গুণী ও সৎ মানুষের সঠিক মূল্যায়ন কি আমরা সমাজে করতে পারছি? তাঁদের যোগ্য মর্যাদা দিয়ে যোগ্য স্থানে আসীন করাতে পারছি? তাঁদের কর্মকাণ্ড ও দিকনির্দেশনা মাথায় রেখে সমাজ পরিচালনা করতে পারছি? প্রশ্নগুলোর উত্তর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘না’। আর এটাই অপসংস্কৃতির অন্যতম প্রধান নিয়ামক। সমাজ অন্ধকারে ডুবে যায় এ কারণেই। আমরা জানি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি হাত ধরাধরি করে চলে। এরা একে অন্যের পরিপূরক। প্রত্যেক মানুষের শিক্ষার অধিকার আছে। তাই সমাজের প্রতিটি স্তরে শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারলেই তাদের হাত ধরে প্রকৃত সংস্কৃতিমান মানুষ সমাজে পাব। আর এটাই হবে সুস্থ সংস্কৃতি। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, সংগীত ও শিল্পীদের অবমূল্যায়ন করে ভয়ংকর এক সাংস্কৃতিক আবহে ডুবে যাচ্ছি, যা অপসংস্কৃতির চরমতম নিদর্শন। প্রকৃত ও প্রশিক্ষিত শিল্পী ও দেশীয় সংস্কৃতির ধারা মূল্যায়ন না করে আমরা আমাদের সংস্কৃতির মূলে কুঠারাঘাত করছি।
খায়রুল আলম সবুজ
সংস্কৃতি মানে শুধু এই নাচ, গান আর অভিনয় নয়; এটি আমাদের সম্পূর্ণ জীবনাচরণ। এর মধ্যে রাজনীতি, শিক্ষাব্যবস্থাও রয়েছে। একজন পরিপূর্ণ মানুষের জন্য দরকার সঠিক ও পরিশুদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা। সেই অবস্থা কি এখন আছে? আমাদের আগের সেই মূল সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। শুদ্ধ জীবনযাপন আমরা তো কবেই হারিয়ে ফেলেছি। একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজ কীভাবে শুদ্ধ সংস্কৃতির চর্চা করবে? তবে নতুন মানুষের হাতে সংস্কৃতি কতটা আশা জাগায় সেটাই এখন দেখার বিষয়। সুস্থ, সুন্দর, সৎ ও শিক্ষিত মানুষ দ্বারা পরিচালিত সমাজ ও তাঁর অনুসারী আপামর মানুষ-অধ্যুষিত দেশ, যোগ্য মানুষের মূল্যায়নের নিশ্চয়তা, ন্যায়বিচার-এগুলো হচ্ছে সুস্থ সংস্কৃতির আরেক চাবিকাঠি।
ফাহমিদা নবী
আদি-অনন্তকাল ধরে প্রবহমান সামাজিক রীতিনীতি, আইনকানুন, অনুশাসন, বিনোদন অর্থাৎ সুস্থ মানসিক বৃত্তি, যা মানবিক গুণাবলি বিকাশে সহায়ক, তা-ই সংস্কৃতি। সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে মানবকুল এবং সমাজকে সুস্থ ও সুন্দরভাবে চলার পাথেয় দান করে চলেছে। সুতরাং সংস্কৃতি সব সময়ই সুস্থ। আর তার ভুল ব্যবহার, ভুল চর্চা, অযৌক্তিক অন্তঃসারশূন্য জীবনাচরণকে সঠিক বলে প্রচার করার ফলে যা তৈরি হয়, সেটা সংস্কৃতি নয়। যাকে আমরা অপসংস্কৃতি বা অসুস্থ সংস্কৃতি বলে বিফল চিৎকার করছি।