ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের সামনে বাংলা গান গেয়ে সেই সত্তরের দশকে তাঁর আশীর্বাদ পেয়েছিলেন বাংলাদেশের কিংবদন্তি সাবিনা ইয়াসমিন। সেই স্মৃতি আজও তাঁর হৃদয়ে অমলিন। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশ নিতে মুম্বাই গিয়েছিলেন তিনি। সেই আয়োজনের এক পার্টিতে লতা মঙ্গেশকরের সামনে গাওয়ার সুযোগ হয়েছিল; যা ‘জীবনের বড় পাওয়া’ হিসেবেই মনে রেখেছেন সাবিনা ইয়াসমিন। সেই আয়োজনে লতা মুঙ্গেশকর, অমিতাভ বচ্চন, শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ থেকে সাবিনা ইয়াসমিন, রাজ্জাক, ববিতা, রোজী আফসারীসহ আরও কয়েকজন ছিলেন। সেই দিনের স্মৃতিচারণা করে সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, শচীন দেব বর্মণ আমাকে বলেছিলেন, ‘মা, তুমি বাংলাদেশের একটা গান শোনাও।’ বললাম, কী রকম গান। বললেন, পল্লীগীতি শোনাও। তখন আমি ‘নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইলা’ গেয়েছিলাম। কোনো মিউজিশিয়ান ছিল না, হারমোনিয়ামে গেয়েছিলাম। সেই আয়োজনে তখনো লতা মঙ্গেশকর এসে পৌঁছাননি। গান শেষ করতেই দূর থেকে লতা মঙ্গেশকরকে ভিতরে আসতে দেখে হারমোনিয়াম রেখে মঞ্চ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম আমি। লতাজিকে দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। তখন আমার বয়সও কম ছিল। যাই হোক, ধরে নিয়ে আসা হলো আমাকে। উনার সামনে গাইলাম। উনি গানের এত প্রশংসা করলেন, আমি কথাই বলতে পারছিলাম না।
সেই আয়োজনে শিল্পী বলতে শচীন দেব বর্মণ, লতা মঙ্গেশকর আর সাবিনা ইয়াসমিনই ছিলেন; বাকিরা সিনেমার প্রযোজক, অভিনয় শিল্পী ও সংগীত পরিচালক। সাবিনা ইয়াসমিন বললেন, ‘গান শেষ হওয়ার পর শচীন দেব বর্মণ আমাদের দুজনকে দুই দিকে ধরে ছবি তুলে বললেন, দুই পাশে দুই দেশের দুই লতাকে নিয়ে ছবি তুলছি। ওই ছবিটা আর আমার কাছে নেই।’ সে সময় লতা মঙ্গেশকর ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্পী ও শ্রোতাদের কাছে অনুকরণীয় একটি নাম; সাবিনা ইয়াসমিন সবে চলচ্চিত্রের গানে নাম লিখিয়েছেন। বয়সও বড়জোড় ২৫ বছর।
সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘উনি আমার খুব প্রশংসা করেছিলেন। আমার গলার খুব প্রশংসা করছিলেন। এটাই আমার পাওয়া। সেদিন অমিতাভ বচ্চন থেকে শুরু করে বলিউডের বড় বড় প্রডিউসার, অভিনয় শিল্পীরা ছিলেন। কথা বলার খুব একটা সুযোগ ছিল না।’
পরে আর লতার সঙ্গে দেখা না হলেও তাঁর গানকে জীবনের অংশ করে নিয়েছিলেন বলে জানালেন সাবিনা। তাঁর ভাষ্য, ‘আমি সারাক্ষণই উনার গান শুনি। প্রতিদিন, এমন কোনো দিন নাই-উনার গান শুনি না।’
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে হাজারের বেশি সিনেমায় গান করেছেন লতা। ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি বিদেশি ভাষাতেও তিনি গান করেছেন; তাঁর মোট গানের সংখ্যা ২৫ হাজারের মতো। এর মধ্যে বাংলা গান প্রায় দুই শ। সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘লতা মঙ্গেশকরের এমন কোনো গান নাই- যেটা আমার ভালো লাগে না। উনার প্রত্যেকটা গান খুব মন দিয়ে আমি শুনি। সুতরাং কোনটা কোনটা ভালো সেটা আমি নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। বলা খুবই মুশকিল।’ লতা মঙ্গেশকরকে ভারতের সর্বকালের সেরা শিল্পীদের মধ্যে একজন বিবেচনা করা হয়; গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতার বলেছিলেন, ‘মাইকেল অ্যাঞ্জেলো মানেই যেমন চিত্রকলা, শেকস্পিয়র মানেই যেমন ইংরেজি সাহিত্য, তেমনই ভারতীয় সিনেমার গান মানেই লতা মঙ্গেশকর।’ বাকিদের থেকে লতা মঙ্গেশকর কোথায় আলাদা? শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের ভাষ্য, ‘উনার গলা আলাদা, গায়কি আলাদা। উনি যে গান শিখেছেন সেটাও অন্যরকম। সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত গলা উনার। এমনটা সৃষ্টিকর্তা উনাকে দিয়েছিলেন।
‘উনি গান গেয়েছেন সেই চল্লিশের দশক থেকে, আমাদের জন্মেরও আগে। উনার গলায় যে কী ছিল, কে জানে; যে গান করতেন, সেই গানই এত সুন্দর হয়ে উঠত, সেটা নিয়ে বলার কোনো ভাষা থাকে না। লতা মঙ্গেশকর, লতা মঙ্গেশকরই।’