প্রথমেই যেটা জরুরি সেটা হচ্ছে মেধা। একজন আর্টিস্টকে বুঝতে হবে ডিরেকশনে যিনি আছেন তিনি আসলে তার কাছে কী ধরনের কাজ চাচ্ছেন? ডিরেকশন অনুযায়ী ক্যামেরার সামনে নিজের সেরাটা উপস্থাপন করতে হবে। ভালো অভিনয় ব্যতীত কেউ নায়ক-নায়িকা হতে পারবে না; যদিও কেউ হয়ে থাকে সেটা সাময়িক। কোনো না কোনো একসময় সে ঝরে পড়ে যাবে।
শোবিজ জগতের ঝলমলে উঠানে পা রেখে রুপালি পর্দার নায়ক-নায়িকা হতে কে না চায়। কিন্তু এ কাজটি কি খুব সহজ? ২০০০ সালের পর থেকে যারা সিনেমায় এসেছেন তাদের কাছে আসলেই নায়ক-নায়িকা হওয়ার ব্যাপারটি খুব সহজ মনে হয়। তারা এ জগতে এসেই নিজের মেধা ও দক্ষতার দিকে না তাকিয়ে কীভাবে সহজে নিজের নামের আগে নায়ক-নায়িকা তকমা লাগিয়ে বাড়ি, গাড়ি আর অর্থবৈভবের মালিক হবেন সেই দিবাস্বপ্ন দেখতেই বিভোর থাকেন। আর যারা নায়িকা হতে আসেন তার মধ্যে অনেকেই নায়িকা তকমা নিজের নামের সঙ্গে এঁটে দিয়ে জড়িয়ে পড়েন একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে। এ তকমা কাজে লাগিয়ে কখনো মনোরঞ্জন কখনো ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে সহজেই আলিশান ফ্ল্যাট ও দামি গাড়ির মালিক বনে যান। কেউ কেউ তাদের ক্লায়েন্টদের সঙ্গে ঘন ঘন বিদেশেও উড়াল দেন। হাতে ছবির কোনো কাজ নেই অথচ শোবিজে অভিষেক ঘটতে না ঘটতে বিপথে পা রেখে প্রচুর অর্থবৈভবের মালিক বনে যান। হাতে থাকে কয়েক লাখ টাকার লেটেস্ট মডেলের আইফোন।
আবার নায়কদের ক্ষেত্রে দেখা যায় অভিনয়জ্ঞান নেই, লোকদেখানো ভাব আর ফাঁকা বুলিতে ক্যারিয়ার গড়তে চান। কেউ কেউ অসদুপায় অবলম্বন করে প্রডিউসার খুঁজে এনে সিনেমার ঘোষণা দেন ঠিকই- সেই সিনেমা আর কখনো নির্মাণ হয় না। আসলে এভাবে কি নায়ক-নায়িকা হওয়া যায়। এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও গবেষক অনুপম হায়াৎ বলেন, অথচ একটা সময় রাজ্জাক, সোহেল রানা, বুলবুল আহমেদ, শাবানা, ববিতা, কবরী প্রমুখরা দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে, নির্ঘুম থেকে কাজ করে খ্যাতি আর অর্থবিত্তের দেখা পেয়েছেন। এ দেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁদের নাম অমর হয়ে থাকবে। কারণ কাজের প্রতি তাঁদের সত্যিকারের ডেডিকেশন ছিল বলেই তাঁরা নায়ক-নায়িকা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। এর সর্বশেষ উদাহরণ টানতে গেলে অবশ্যই সালমান শাহ, মৌসুমী, শাবনূর, পপি, পূর্ণিমার নাম উল্লেখ করতেই হবে। চলচ্চিত্র নির্মাতা মনতাজুর রহমান আকবর বলেন, আজকাল টাকা আর ইজ্জত বিলি করে অনেকেই রুপালি পর্দায় কাজ করতে চাচ্ছেন। এমনকি অনেকে করছেনও বটে। কিন্তু এরা হচ্ছে আগাছার মতো। এরা বটবৃক্ষের মতো বাড়তে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। আসলে নিজেকে নায়ক-নায়িকা হিসেবে জাহির করার কিছু নেই। ভালো অভিনয় করলে এমনিতেই মানুষ গ্রহণ করবে, খ্যাতি ধরা দেবে। নির্মাতা দেবাশীষ বিশ্বাস বলেন, নায়ক হতে গেলে ভালো অভিনয়-নাচ-ফাইট এই তিনটা জিনিস অবশ্যই প্রয়োজন। এর সঙ্গে একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডও দরকার। আমাদের এখানে যদিও অভিনয়ে শিক্ষার তেমন প্রতিষ্ঠান নেই। তবু বিভিন্ন নাট্যদল থেকে অভিনয়ের শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে। অনেক শক্তিমান ও জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী পেয়েছি বেশ কিছু নাট্যদলের সুবাদে। তা ছাড়া নায়ক-নায়িকাকে সৎ, নিরহংকারী হতে হবে। আর একটা চেতনা থাকতে হবে সেটা হচ্ছে- গাড়ি-বাড়ির পেছনে না ছুটে অভিনয়টাকে মনের মধ্যে লালন করতে হবে। সিনিয়র সাংবাদিক আবদুর রহমান বলেন, ‘নায়ক-নায়িকা হওয়ার আগে সর্বপ্রথম তাকে একজন ভালো মানুষ হতে হবে। সিয়িনয় শিল্পী, সাংবাদিক, পরিচালক-প্রযোজক ছাড়াও তার চারপাশের সবাইকে শ্রদ্ধা করতে হবে। কজের প্রতি সিনসিয়ারিটি, শ্রদ্ধা, সময়জ্ঞান থাকতে হবে। খুব বেশি সুদর্শন হতে হবে তা কিন্তু নয়। কারণ বলিউডের দিকে তাকালে দেখতে পাই সুনীল শেঠী, অক্ষয় কুমার, নাসিউদ্দিন শাহ, স্মিতা পাতিল, শাবানা আজমিরা কিন্তু চেহারা দিয়ে নয়, মেধা ও অভিনয় দক্ষতা দিয়ে কালজয়ী নায়ক-নায়িকা হয়েছেন। এ ছাড়া শিক্ষার একটা ব্যাপার তো আছেই। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তাফিজুর রহমান মানিক বলেন, আমার দৃষ্টিতে সত্যিকারের নায়ক ও নায়িকা হতে গেলে সবার আগে কাজের প্রতি প্রেম থাকতে হবে। কাজের স্বার্থে কাজের প্রতিই মনস্থির করতে হবে। এ ছাড়া ক্যামেরার সামনে কীভাবে সহজাত এবং সাবলীল অভিনয় করতে হয় সাধনার মাধ্যমে সেটি রপ্ত করতে হবে। প্রবীণ চিত্রপরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু বলেন, প্রথমেই যেটা জরুরি সেটা হচ্ছে অভিনয় করার মেধা। একজন আর্টিস্টকে আগে বুঝতে হবে ডিরেকশনে যিনি আছেন তিনি আসলে তার কাছে কী ধরনের কাজ চাচ্ছেন? ডিরেকশন অনুযায়ী ক্যামেরার সামনে নিজের সেরাটা উপস্থাপন করতে হবে। ভালো অভিনয় ব্যতীত কেউ নায়ক-নায়িকা হতে পারবে না; যদিও কেউ হয়ে থাকে সেটা সাময়িক। কোনো না কোনো একসময় সে ঝরে পড়ে যাবে। আবার বর্তমানে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে হলে নাচ, ফাইট, দৈহিক গঠনও আকর্ষণীয় হওয়া চাই। চিত্রনায়িকা সুচন্দা বলেন, যে কোনো কাজে পরিশ্রম ব্যতীত সফলতা অর্জন সম্ভব নয়। সুতরাং নায়িকা হতে হলে আগে তাকে পরিশ্রমী হতে হবে। অন্যসব দিবাস্বপ্ন বাদ দিয়ে কাজের প্রতি শতভাগ ডেডিকেটেড হতে হবে। সময় মেনে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সঠিকভাবে চলতে হবে। রাতারাতি খ্যাতি পাওয়ার কথা না ভেবে নিজেকে এখানে প্রতিষ্ঠিত করার কথা ভাবতে হবে। চলচ্চিত্র নির্মাতা মতিন রহমান বলেন, অভিনয়টা সাধনার বিষয়। নায়ক-নায়িকা হতে হলে তাকে সেই সাধনায় ব্রত হতে হবে। লোকদেখানো বা অন্য কোনো নেতিবাচক উদ্দেশ্যে নায়ক-নায়িকা হওয়ার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ছটকু আহমেদ বলেন, প্রথম অভিনয় করার ক্ষমতা থাকা দরকার। এ ছাড়া নায়ক-নায়িকাদের অন্যদের চেয়ে লুকিং-এ একটু ভিন্ন হতে হবে, যাতে মানুষ দেখলেই যেন বুঝতে পারে ইনি নায়ক অথবা নায়িকা। পাশাপাশি সাবলীল উচ্চারণ ও নাচ এবং ফাইটিংয়ে পারদর্শী হতে হবে।