দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের সীমান্ত। ২৪ জুলাইয়ের সংঘর্ষে থাই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১২ জন মানুষ নিহত হয়েছেন; তাদের মধ্যে একজন ছাড়া সবাই বেসামরিক নাগরিক। অন্যদিকে, কম্বোডিয়ার পক্ষ থেকে এখনো কোনো হতাহতের তথ্য নিশ্চিত করা হয়নি।
প্রথমদিকে এটিকে সীমান্তবর্তী এলাকা সংক্রান্ত সাধারণ একটি ছোটখাটো সংঘর্ষ হিসেবে মনে করা হচ্ছিল। ২৩ জুলাই, পাঁচজন থাই সেনা সদস্য সীমান্ত এলাকায় একটি ল্যান্ডমাইনে আহত হলে পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
এই ঘটনার পেছনে রয়েছে জটিল রাজনৈতিক সম্পর্ক ও পারস্পরিক সন্দেহ। গত মাসে কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান ক্ষমতাসীন পরিবারের প্রধান হুন সেন থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা সঙ্গে একটি ব্যক্তিগত ফোনালাপ ফাঁস করে দেন। এতে পেতংতার্ন তাকে ‘আঙ্কেল’ বলে সম্বোধন করেন এবং নিজের এক সামরিক কমান্ডারের সমালোচনা করেন। ফাঁস হওয়া ফোনালাপ থাইল্যান্ডে রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করে এবং পেতংতার্নকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।
এই ফাঁস হওয়া ফোনালাপ কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, দীর্ঘদিনের পারিবারিক বন্ধনকেও চূর্ণ করে দেয়। হুন সেন ও সিনাওয়াত্রা পরিবার বহু বছর ধরেই একে অপরের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। এমনকি ২০১৪ সালে, থাকসিনের বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রার সরকার সেনা অভ্যুত্থানে পতনের পর হুন সেন তার সমর্থকদের কম্বোডিয়ায় আশ্রয় দিয়েছিলেন।
কিন্তু বর্তমানে সম্পর্কের অবনতি শুধু রাজনৈতিক কথোপকথনে সীমাবদ্ধ নেই। থাই পুলিশ সম্প্রতি কিছু প্রভাবশালী কম্বোডিয়ান ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অনলাইন জুয়া ও স্ক্যাম চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে। এর প্রেক্ষিতে দুই দেশের মধ্যে শত শত কোটি ডলারের বাণিজ্য কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।
উভয় দেশের অর্থনীতি ইতিমধ্যেই চাপে রয়েছে। থাইল্যান্ডে ধীরগতি অর্থনীতি ও সম্ভাব্য মার্কিন শুল্কের হুমকি রয়েছে। অন্যদিকে, কোভিড-পরবর্তী সময়ে কম্বোডিয়ার পর্যটন খাত এখনো পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। চীনা পর্যটকদের অনুপস্থিতি ও স্ক্যাম চক্র নিয়ে আতঙ্ক পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, হুন সেনের এই উত্তেজনা সৃষ্টির কারণ নিয়ে বিশ্লেষকরা দ্বিধায় রয়েছেন। কেউ মনে করেন, থাইল্যান্ডের জুয়া বৈধ করার পদক্ষেপ হয়তো কম্বোডিয়ার ক্যাসিনো ব্যবসার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার কেউ এটিকে হুন সেনের একটি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখছেন—পুরোনো মিত্র থাকসিন সিনাওয়াত্রা, যিনি এখন ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে, তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজের জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তি পুনর্গঠন করা।
বর্তমানে, কম্বোডিয়ার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে তাদের কাছে এমন গোপন নথি আছে যা থাকসিনকে রাজপরিবার অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারে—একটি মারাত্মক অভিযোগ যা থাইল্যান্ডে কঠোর শাস্তিযোগ্য। এর প্রতিক্রিয়ায় থাইল্যান্ড কম্বোডিয়ান রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে এবং নিজ দেশের দূতকেও ফিরিয়ে এনেছে।
এই পরিস্থিতিতে উভয় দেশের পক্ষ থেকেই আপোষ বা সংযমের কোনো ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না। কম্বোডিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত, যিনি হুন সেনের পুত্র, এখনো নিজস্ব রাজনৈতিক ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারেননি। অন্যদিকে, থাইল্যান্ডের জোট সরকারও সংকটে পড়েছে।
এই জটিল পরিস্থিতিতে আশার আলো হতে পারে আসিয়ান। সংগঠনটি গঠিত হয়েছিল এমন সংঘাত রোধের উদ্দেশ্যে। আগামী দিনে আসিয়ানের সদস্য দেশগুলো কি এই উত্তেজনা প্রশমনে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, কেন হুন সেন নিজেই এত বছরের বন্ধুত্ব ভেঙে এই সংঘাতে আগুন ধরিয়ে দিলেন?
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল