চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদানের প্রতি উৎসাহ হারিয়েছে চলচ্চিত্রকাররা। তাদের কথায় একাধিক কারণে বিতর্কিত হয়ে পড়েছে অনুদান প্রথা। অর্থের পরিমাণ কম, রাজনৈতিক ও দলীয় বিবেচনা এবং অনেক ক্ষেত্রে মানহীন পাণ্ডুলিপিকে নির্বাচন করায় আস্থা হারিয়েছে সরকারি অনুদান। এ ছাড়া অনুদান পাওয়া অনেক ছবি আজো আলোর মুখ দেখেনি। এ ব্যাপারে সরকারি কোনো মনিটরিংয়ের ব্যবস্থাও নেই। এমন অভিযোগ করে চলচ্চিত্রকাররা বলছেন, অনুদান নয়, চলচ্চিত্রকে কর মুক্ত করা হোক। তা হলেই মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণে গতি আসবে।
১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে অনুদান ব্যবস্থা প্রবর্তন করে সরকার। প্রথমে ২৫ লাখ করে দুটি চলচ্চিত্রকে অনুদান দেওয়া হতো। ২০০৭ সাল থেকে ৩টি এবং ২০১০ সাল থেকে পাঁচটি চলচ্চিত্রকে অনুদান দেওয়া হচ্ছে এবং প্রতিটি চলচ্চিত্র নির্মাণে ৩৫ লাখ টাকা নগদ এবং এফডিসি থেকে ১০ লাখ টাকার কারিগরি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া পাণ্ডুলিপির জন্য দেওয়া হয় ৫০ হাজার টাকা করে। এ অর্থ বছর থেকে পাঁচটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের পাশাপাশি সমসংখ্যক শিশুতোষ চলচ্চিত্রকেও সমহারে অনুদান দেওয়া হচ্ছে। চলচ্চিত্রকারদের অভিযোগ, অনুদানপ্রাপ্ত বেশির ভাগ চলচ্চিত্রই এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো_ ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রশান্ত অধিকারির 'হার্ডসনের বন্দুক', সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকীর 'একা একা', মারুফ হাসান আরমানের 'নেকড়ে অরণ্য', দেলোয়ার জাহানের ঝন্টুর 'হেড মাষ্টার'। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এনামুল করিম নির্ঝরের 'নমুনা', ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জুনায়েদ আহমেদ হালিমের 'স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের কাল', ২০১০-১১ অর্থবছরে পি এ কাজলের 'মুক্তি', মির্জা সাখাওয়াতের 'হরিজন'। এ ছাড়া এর আগের অনুদানপ্রাপ্ত অনেক চলচ্চিত্রই মুক্তি পায়নি। চলচ্চিত্রকাররা বলছেন দুঃখজনক হলেও সত্য, অনুদানপ্রাপ্ত কটি চলচ্চিত্র এ পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে বা পায়নি তার হিসাব খোদ তথ্য মন্ত্রণালয়েই নেই। তথ্য মন্ত্রণালয়ে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, অনুদানের চলচ্চিত্রের একটি তালিকা হালনাগাদের কাজ চলছে। এদিকে, ১৩ মে ২০১২ সালে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনের ২ নং শর্তে উল্লেখ করা হয়, 'অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাণ অনুদানের প্রথম চেক প্রাপ্তির ৯ মাসের মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে। তবে বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে স্ক্রিপ্টের প্রয়োজনে সরকার উক্ত সময় বৃদ্ধি করতে পারবে।' একই প্রজ্ঞাপনের ১৫ নং শর্তে আরও উল্লেখ রয়েছে, 'অনুদানের অর্থ গ্রহণের পর অনুমোদিত সময়ের মধ্যে চলচ্চিত্র নির্মাণ না করা হলে প্রযোজককে সমুদয় অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে হবে।' চলচ্চিত্রকাররা বলছেন, এ দুটি শর্তের একটিও অনুদানপ্রাপ্তরা পালন করে না এবং সরকারও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন বলেন, আমি কখনো অনুদানের জন্য আবেদন করিনি বা করব না। কারণ অনুদান ব্যবস্থা শুরু থেকেই বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। একে দলীয়করণ করা হয়েছে এবং এর কোনো স্বচ্ছতা বা জবাবদিহিতা নেই। তাই অনুদান প্রথা বাতিল করে চলচ্চিত্রকে কর মুক্ত করলে সরকারি অর্থের অপচয় রোধ হবে এবং মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণ হবে। চলচ্চিত্রকার সুচন্দা বলেন, 'বরফগলা নদী' নির্মাণের জন্য একাধিকবার অনুদান চেয়ে পাইনি। আসলে রাজনৈতিক কারণেই আমাকে অনুদান দেওয়া হচ্ছে না। এ অবস্থার অবসান হওয়া উচিত। চলচ্চিত্রকার আজিজুর রহমান বলেন, প্রথম দিকে গুণী নির্মাতা ও মানসম্মত পাণ্ডুলিপি দেখে অনুদান দেওয়া হতো। যেমন_ সূর্যদীঘল বাড়ী, দহন, পোকামাকড়ের ঘর বসতি, পুরস্কার, হাজার বছর ধরেসহ আরও অনেক চলচ্চিত্র। কিন্তু ক্রমেই এখন যাচ্ছেতাই নির্মাতা ও পাণ্ডুলিপি সরকারি অনুদান পাচ্ছে। এতে অনুদান প্রদানের প্রকৃত অর্থ ব্যাহত হচ্ছে। সরকারকে এ অবস্থা রোধে ব্যবস্থা নিতেই হবে। চলচ্চিত্রকার সিবি জামান বলেন, একদিকে অর্থের পরিমাণ কম তার ওপর কয়েক কিস্তিতে টাকা দেওয়া হয়। এতে নির্মাতাকে বিপাকে পড়তে হয়। তাই অনুদান নয়, চলচ্চিত্রকে করমুক্ত করা হোক। এতে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।