অভিনেতার মতো ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও সমান জনপ্রিয় ফারুক। আশির দশকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সবুজ সংঘের দায়িত্বভার গ্রহণ করে ফুটবল খেলার মানোন্নয়নে অপরিসীম ভূমিকা রাখেন তিনি। টানা ১০ বছর এই দায়িত্ব পালনের এক পর্যায়ে ফুটবল নিয়ে যখন রাজনীতি শুরু হলো তখন হতাশা ও দুঃখ নিয়ে এই দায়িত্ব ত্যাগ করেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে ফারুক বলেন, আর মাত্র তিন দিন পরেই বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসছে। এই খেলা একসময় মাঠ থেকে টেবিলে চলে যাওয়ায় আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে আর পৌঁছতে পারিনি। ফারুক বলেন, সবুজ সংঘ ছিল বাংলাদেশের একমাত্র ফুটবল প্লেয়ার হান্টিং ক্লাব। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই নিউ ইস্কাটনে ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে এই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ক্যাপ্টেন এহতেশাম। ১৯৮০ সালে আমি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিই। তখন আমার সঙ্গে ছিলেন সোহাগ পরিবহনের ডিরেক্টর বাবুল। টিটন ছিলেন আমার সেক্রেটারি। ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন এএসপি আবদুল বাতেন। বাবুল নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে সারা দেশ থেকে প্লেয়ার হান্ট করত। সবুজ সংঘ ছোট পরিসরের ক্লাব হওয়া সত্ত্বেও সেখানে খেলোয়াড়দের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতাম। প্লেয়ারদের অভিভাবকরা লাখ লাখ টাকা ডোনেশন দিয়ে সহযোগিতা করতেন। এ মুহূর্তে নাম মনে নেই এমন অনেকের সহায়তায় একসময় হাঁটি হাঁটি পা-পা করে সবুজ সংঘের ফুটবল টিম থার্ড ডিভিশনের টিমে পরিণত হয়। এ অবস্থায় পৌঁছার পর বাবুল আমাকে বলেন, আপনি যদি সকালে খেলোয়াড়দের প্র্যাকটিসের সময় উপস্থিত থাকেন তাহলে তারা উৎসাহ পাবে। আমি শুটিং এবং অন্য কাজ বাদ দিয়ে তাই করতাম। সোহাগ পরিবহন তখন আমাদের চারটি বাস এবং টাকা পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করে। বাসে করে ইস্কাটন থেকে খেলোয়াড়, সমর্থক আর কর্তাব্যক্তিদের আউটার স্টেডিয়ামে খেলার দিন নিয়ে যেতাম। আশির দশকের মাঝামাঝিতে অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের টিম সেকেন্ড ডিভিশনে উন্নীত হয়। এতে সবার উৎসাহ আরও বেড়ে যায়। তখন আমাদের দলের প্লেয়ার আরমানসহ (পরে জাতীয় দলের অধিনায়ক হন) সবাইকে বলতাম, সবার কাছে আমার একটিই অনুরোধ, তোরা যদি পারিস পরের বছর টিমকে ফার্স্ট ডিভিশনে নিয়ে যাস। তাদের অক্লান্ত শ্রমে এক বছরেই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় আমাদের টিম। ফার্স্ট ডিভিশনে ওঠার পর প্রথম খেলাতেই মোহামেডানকে পরাজিত করে সবুজ সংঘ। এরপর সাফল্যের সঙ্গে এগোতে লাগলাম। কিন্তু দ্রুত এই সফলতা বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের খেলোয়াড়দের ওপর অন্যদের নজর পড়ে। শুরু হলো বিগ গেম। আমাদের খেলোয়াড়দের নিয়ে যাওয়া শুরু হলো। একসময় ভাবলাম ক্লাব চালাতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন, যা আমাদের নেই। তাই বাধ্য হয়ে খেলোয়াড় বেচতে শুরু করলাম। নব্বই দশকের শুরুতে এসে দেখলাম খেলা মাঠ থেকে টেবিলে চলে গেছে। ক্লাব টু ক্লাব পলেটিক্যাল গ্যাম্বলিং শুরু হলো। তখন মনে হলো এ অবস্থায় আর থাকা যায় না। কারণ খেলা আর সংস্কৃতি হলো গুণ ও মেধার সমন্বিত অর্জন। কিন্তু এই খেলাতেই যখন রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে তখন এর মৌলিকত্ব বা অস্তিত্ব বলে আর কিছু থাকবে না। প্রচণ্ড দুঃখ আর ক্ষোভ নিয়ে অনেক কষ্টে গড়া সবুজ সংঘের ফুটবল থেকে ক্রিকেটের দায়িত্ব নিলাম। তখন আমাদের ক্লাবের ক্রিকেট টিমে অপিসহ অনেকে ছিলেন। তাদের নিয়ে টিম পুনর্গঠন করি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি বলেছিলাম বাংলাদেশের ক্রিকেট টিম অচিরেই বিশ্বকাপে খেলবে। তাই হলো। যে আমার সংস্পর্শে এসেছে সেই বেস্ট হিসেবে নাম কুড়িয়েছে। ক্রিকেট বোর্ড আমার ১১ জন ছেলেকে নিয়ে নিল। অস্ট্রেলিয়ায় তাদের ট্রেনিংয়ে পাঠানো হলো। তারা এসে ফার্স্ট ডিভিশনে খেলা শুরু করল। গর্বে আমার বুকটা ভরে গেল। আসলে বাংলাদেশের ক্রিকেট ১৯৬৪ সালেই বিশ্বকাপে খেলতে পারত। কিন্তু বাঙালি বলে ঈর্ষা করে পাকিস্তান সরকার তা হতে দেয়নি। তখন ক্রিকেট টিমে কোরান সাহেব, বকুল ভাইসহ অনেকের দক্ষতায় পূর্ব পাকিস্তানে খেললে শত ভাগ মার্ক পেত। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের বাঙালি বলেই জিরো দেওয়া হতো। আমার মতে খেলাধুলা, সংস্কৃতি আর পড়ালেখায় কখনো রাজনীতি আসা উচিত নয়। কারণ এই তিনটিই হচ্ছে জাতির মেরুদণ্ড। এগুলোর মাধ্যমেই একটি জাতি বিশ্বে পরিচিতি পায়। যেমনটি পেয়েছে ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশ স্থান করে নেওয়ায়। সবশেষে ফুটবল নিয়ে একটি দুঃখবোধের কথা উল্লেখ করতে চাই। ফুটবলের জাদুকর খ্যাত সামাদ ভাই। তিনি একবার খেলার সময় বলে তিনটি কিক দিয়ে বলেছিলেন গোলবার নিচু আছে একে ঠিক করতে হবে। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা গেল তার কথাই ঠিক। আজ সামাদ ভাইয়ের মতো খেলোয়াড়ের দেশ মানে বাংলাদেশের ফুটবলের বর্তমান বিধ্বস্ত অবস্থায় আমি ব্যথিত। ফুটবলের ক্ষেত্রে আমাদের পিছিয়ে পড়াটা সত্যিই দুঃখজনক।