নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকেই আমাদের চলচ্চিত্র গতি হারিয়েছে। নকল, অশ্লীলতা, বিদেশি স্যাটেলাইট চ্যানেল, সিডি-ভিসিডি,পাইরেসি, প্রেক্ষাগৃহের অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি প্রতিকূলতা ঘাতক ব্যাধির মতো নানা সময়ে কুরে কুরে খেয়েছে চলচ্চিত্রকে। দর্শক হয়েছেন প্রেক্ষাগৃহবিমুখ। সিনিয়র প্রখ্যাত নির্মাতারা এসব অধঃপতনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন। এর সঙ্গে যোগ হয় আধুনিক প্রযুক্তি, ধ্যান-ধারণা এবং নতুন প্রজন্মের রুচি। এসব ব্যবস্থাও আমাদের চলচ্চিত্রে তখন অনুপস্থিত। এক সময় এই বন্ধ্যত্ব কাটাতে একে একে এগিয়ে এলেন কিছু নতুন মুখ, তরুণ নির্মাতা।
২০০৮ সালে গিয়াসউদ্দিন সেলিম 'মনপুরা' চলচ্চিত্র নিয়ে হাজির হলেন দর্শকদের সামনে। এই নির্মাতা চলচ্চিত্রের উঠোনে আশার আলো জ্বেলে দিলেন। সেই আলোর পথ ধরে নতুনদের হাঁটা এখনো থামেনি। ২০১০ সালে চলচ্চিত্রকে আধুনিক প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করে প্রেক্ষাগৃহে এলেন এম এ জলিল অনন্ত ও ইফতেখার চৌধুরী। অনন্ত প্রযোজিত ও অভিনীত এবং ইফতেখার পরিচালিত 'খোঁজ দ্য সার্চ' ছবিটির মাধ্যমে এদেশের দর্শক পেলেন সময় উপযোগী আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। বিশ্বমানের প্রযুক্তি নিয়ে অনন্তর অগ্রযাত্রা এখনো অব্যাহত আছে। ২০১২ সালে তরুণ নির্মাতা অনন্য মামুন নির্মাণ করলেন 'মোস্ট ওয়েলকাম'। এই ছবির প্রযোজকও অনন্ত জলিল। ছবিটির মাধ্যমে নতুন প্রযুুক্তি আরও একধাপ এগিয়ে গেল। চলচ্চিত্র নির্মাণে নবপ্রযুক্তির সঞ্চার হলেও প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শন ব্যবস্থা রয়ে গেল ৩৫ মিলিমিটার অর্থাৎ এনালগ পদ্ধতিতে। এই বন্ধ্যত্ব কাটাতে ২০১১ সালে এগিয়ে এলেন জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ। দেশের শতাধিক প্রেক্ষাগৃহকে ডিজিটালে রূপান্তর করেন তিনি। এই প্রযুক্তিতে তিনি নির্মাণ ও প্রদর্শন করলেন 'ভালোবাসার রঙ' ছবিটি। আবদুল আজিজের উদ্যোগে ঝকঝকে ছবি ও নিখুঁত শব্দ পেয়ে দর্শক প্রেক্ষাগৃহে ফিরতে শুরু করেন। আজিজের আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ও সময় উপযোগী নির্মাণ এখনো অব্যাহত রয়েছে।
আরও নতুন যারা ইতিমধ্যে সময় উপযোগী গল্প, শিল্পী, নির্মাণ ও প্রযুক্তি নিয়ে দর্শক মনে স্থান করে নিয়েছেন তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন- এস এ হক অলিক [হৃদয়ের কথা, আকাশছোঁয়া ভালোবাসা], সালাউদ্দিন লাভলু [মোল্লাবাড়ীর বউ], মোস্তফা সরয়ার ফারুকী [ব্যাচেলর, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, টেলিভিশন, পিঁপড়াবিদ্যা] তৌকীর আহমেদ [জয়যাত্রা, দারুচিনি দ্বীপ, রূপকথার গল্প], মোস্তফা কামাল রাজ [প্রজাপতি, তারকাঁটা] মুরাদ পারভেজ [চন্দ্রগ্রহণ], স্বপন আহমেদ [লালটিপ], রেদোয়ান রনি [চোরাবালি], শাহিন কবির টুটুল [এইতো ভালোবাসা], সোহেল আরমান [এইতো প্রেম], নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুল [এক কাপ চা], সানিয়াত [অল্প অল্প প্রেমের গল্প], মাসুদ পথিক [নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ], শিহাব শাহিন [ছুঁয়ে দিলে মন], গাজী রাকায়েত [মৃত্তিকা মায়া], শাহনেওয়াজ কাকলী [উত্তরের সুর], মনসুর আলী খান [৭১ এর সংগ্রাম], বাপ্পারাজ [কার্তুজ], অনিমেষ আইচ [জিরো ডিগ্রী], নোমান রবিন [কমন জেন্ডার], অনন্য মামুন [আমি শুধু চেয়েছি তোমায়], আশরাফ শিশির [গাড়িওয়ালা] প্রভৃতি। এসব নতুন নির্মাতারা দর্শকমন জয়ের পাশাপাশি চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণেও সক্ষম হন। তাছাড়া তাদের অনেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননাও লাভ করেন।
নায়করাজ রাজ্জাক বলেন, 'চলচ্চিত্র নির্মাণে মেধাবী তরুণরা এগিয়ে আসছে এবং তারা মেধা ও মননের স্বাক্ষর রেখে উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এটি এ শিল্পের জন্য শুভ ইঙ্গিত। আমার বিশ্বাস, আমাদের মতো ভালো কাজ দিয়ে তারাও চলচ্চিত্রকে পূর্ণতা দিয়ে যাবে। প্রখ্যাত সাংবাদিক অনুপম হায়াৎ বলেন, দর্শকের রুচি ও আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে তরুণ নির্মাতারা দর্শক গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। এটি চলচ্চিত্রের বর্তমান ক্রান্তিলগ্নে আশার আলো। নতুনরা দৃশ্যায়নে বৈচিত্র্য আনতে ব্যবহার করছে স্পেনিং শর্ট। যা দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠছে। পাশাপাশি সংগীতের কথাও বলতে হয়। নতুনরা এ ক্ষেত্রে ভ্যারিয়েশন আনতে সক্ষম হয়েছে।
তারা নিয়মিত চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তরুণদের হাতেই আধুনিক ও ভবিষ্যৎ চলচ্চিত্র। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেল বলেন, তরুণ নির্মাতাদের মধ্যে সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। তবে তাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার ব্যবস্থা করতে পারলে আর কোনো বাধাই থাকত না। আমি স্বল্প পরিসরে এ জন্য ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স চালু করেছি। কিন্তু বৃহৎভাবে এটি চালু করা দরকার। আর এ উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। তাহলে নতুনরা আমাদের মৃতপ্রায় চলচ্চিত্রে পুরোদমে প্রাণসঞ্চারে সক্ষম হবেন। বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার সুচন্দা বলেন, সময় উপযোগী চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজন আধুনিক চিন্তা-চেতনা ও প্রযুক্তির সমন্বয়। তরুণরা এটি করতে পারছে বলেই মৌলিক কিংবা বাণিজ্যিক, উভয় ক্ষেত্রেই সফল হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আরও বলতে হয়, বর্তমানে শোনা যায়, প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশের কারণে দর্শক ছবি দেখতে যায় না। এটি ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে তরুণ নির্মাতারা। মনপুরা, মোল্লাবাড়ীর বউ, হৃদয়ের কথা সব প্রেক্ষাগৃহেই দর্শক সপরিবারে দেখেছে। যেহেতু এখন উন্নত প্রযুক্তি এবং প্রতিযোগিতার যুগ, তাই প্রেক্ষাগৃহগুলো অবশ্যই আধুনিক করতে হবে।